আজো আমি ঠিক তেমনি করেই ভাবি কিন্তু তুমি বোধ হয় তা বিশ্বাস কর না। তুমি অনেক দূরে সরে গেছ। আমি সেদিন যেখানে ছিলাম আজো সেখানে আছি।
ভালবাসা কি সেই সম্পর্কে আমার একটি থিওরি আছে। কাউকে কখনো বলিনি–তোমাকে বলি। আমার ধারণা প্রকৃতি প্রথমে একটি চমৎকার নকশা তৈরী করে। অপূর্ব একটি ডিজাইন। যা জটিল এবং ভয়াবহ রকমের সুন্দর। তারপর সেই ডিজাইনটি কাঁচি দিয়ে কেটে দুভাগ করে। এক ভাগ দেয় একটি পুরুষকে অন্য ভাগ একটি তরুণীকে। পুরুষটি তখন ব্যাকুল হয়ে ডিজাইনের বাকি অংশ খুঁজে বেড়ায়। মেয়েটিও তাই করে। কেউ যখন তার ডিজাইনের কাছাকাছি কিছু দেখে তখন প্রেমে পড়ে যায়। তারপর দেখা যায় ডিজাইনটি ভুল। তখন ভয়াবহ হতাশা। আমার মনে হয় প্রকৃতির এটা একটা মজার খেলা। মাঝে মাঝে প্রকৃতি কি করে জান? মূল ডিজাইনের দুই অংশকে কাছাকাছি এনে মজা দেখে, আবার সরিয়ে নিয়ে যায়। প্রকৃতি চায় না এরা একত্র হোক। দুজনে মিলে মূল ডিজাইনটি তৈরী করুক। প্রকৃতির না। চাওয়ার কারণ আছে–মূল ডিজাইন তৈরী হওয়া মানে এ্যাবসলিউট বিউটির মুখোমুখি হয়। প্রকৃতি মানুষকে তা দিতে রাজি নয়। প্রকৃতির ধারণ মানুষ এখনো তার জন্যে তৈরী হয় নি।
তোমাকে এত সব বলার অর্থ একটিই–আমি সব সময় ভেবেছি তোমার কাছে ডিজাইনের যে অর্ধাংশ আছে তার বাকিটা আমার কাছে…
এই পর্যন্ত লিখে শওকত সাহেবের মনে হল তিনি মিথ্যা কথা লিখছেন। রের কাছে মূল ডিজাইনের অর্ধাংশ নেই। রেণুর কাছে তিনি কখনো মিথ্যা বলেননি–আজ কেন বলবেন?
স্যার, ও স্যার।
শওকত সাহেব বের হয়ে এলেন। বাবু ছাতিম গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে কুকুরের বাচ্চার মত একটা কি যেন দেখা যাচ্ছে। বাচ্চাটা কুঁই কুঁই করছে।
কি চাও তুমি?
এটা স্যার শিয়ালের বাচ্চা। আমি একটা শিয়ালের বাচ্চা ধরে ফেলেছি। আচ্ছা স্যার শিয়ালের বাচ্চাকে কি কুকুরের মত ট্রেনিং দেওয়া যায়?
শওকত সাহেব তীব্র ও তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আর কখনো তুমি আমার আশে-পাশে আসবে না। কখনো না।
বাবু অবাক হয়ে বলল, রাগ করতেছেন কেন স্যার?
তিনি ক্ষিপ্তের মত চেঁচালেন, যাও তুমি, যাও বলছি।
এমন করতেছেন কেন? আপনের কি হইছে?
হৈ চৈ শুনে লোক জমে গেল। শওকত সাহেব বজরার ভেতর ঢুকে গেলেন। সারা বিকাল বিছানায় শুয়ে রইলেন। সন্ধ্যার আগে আগে করিম সাহেব এলেন চা নিয়ে। হাসি মুখে বললেন, দারুন খবর পাওয়া গেছে স্যার। মঠ একটা না। আরো দুটা আছে। দেখতে একই রকম, তবে সাইজে ছোট।
শওকত সাহেব বললেন, করিম সাহেব আপনি এখন যান। আমার শরীরটা ভাল লাগছে না।
কি হয়েছে জ্বর জ্বারি না-কি?
জি-না।
ভবেশ বাবুকে খবর দিব?
কাউকে খবর দিতে হবে না।
মঠে কবে যাবেন বললে ব্যবস্থা করে ফেলি।
করিম সাহেব, আমি চুপচাপ খানিকক্ষণ শুয়ে থাকব।
চা খাবেন না?
না। আমি রাতেও কিছু খাব না। খাবার পাঠাবেন না।
করিম সাহেব চিন্তিত মুখে ফিরে গেলেন।
সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল। বজরার মাঝি এল বাতি জ্বালাতে। তিনি তাকে ফিরিয়ে দিলেন। অন্ধকারে বজরার ছাদে বসে রইলেন। চারদিকে ঝিঝি ডাকছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আজো কি সেদিনের মতে ঝড় হবে?
রাতে খাবার নিয়ে এল পুষ্প। সে একা আসনি, বাবুকে নিয়ে এসেছে। বাবুর হাতে হারিকেন।
পুষ্প বজরায় উঠে বাবুকে বিয়ে করে দিল। সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শওকত সাহেবকে বলল, আপনার বার এনেছি।
তিনি চুপ করে রইলেন।
পুষ্প বলল, খাওয়া শেষ করে আপনি আমার সঙ্গে যাবেন। আজ রাতে বাসায় থাকবেন। আজো ঐ দিনের মত ঝড় হবে। দিনের অবস্থা ভাল না।
আমার ক্ষিধে নেই পুষ্প।
আপনি কি রাগ করেছেন?
রাগ করি নি। কি নিয়ে রাগ করব আমি?
বাবু ভাই বলছিল, আপনি নাকি তাকে খুব বকা দিয়েছেন। সে আপনার রাগ দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে। তার ধারণা ছিল আপনি ফেরেশতার মত মানুষ।
তোমার কি ধারণা?
আপনি খাওয়া শুরু করুন তারপর বলব।
শওকত সাহেব খেতে বসলেন। পুষ্প ঠিক তার সামনে বসেছে। তার মুখ হাসি হাসি। যেন কোন একটা ব্যাপারে সে খুব মজা পাচ্ছে।
শওকত সাহেব বললেন, খাওয়া শুরু করেছি এখন বল আমার সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?
আজ বলবনা। আপনি যেদিন চলে যাবেন সেদিন বলব। তাছাড়া আমার মনে হয় আপনাকে বলার দরকার নেই। আমার মনে কি আছে তা আপনি ভালই জানেন।
পুষ্প এত নিশ্চিন্ত হয়ে কথাগুলি বলল যে তিনি চমকে উঠলেন। সেই চমক পুষ্পের চোখ এড়াল না।
বাবু ছেলেটিকে তোমার কি খুব পছন্দ?
হ্যাঁ পছন্দ।
কতটুক পছন্দ?
আপনি যতটুক ভাবছেন তার চেয়ে অনেক কম।
কেন পছন্দ বলতো?
ওর মধ্যে কোন ভান নেই। লুকোছাপা নেই। যা তার মনে আসে সে তাই বলে। যা তার ভাল লাগে–করে। আমরা কেউ তা পারি না। আপনার যা ইচ্ছা করে আপনি কি তা করতে পারবেন?
কেন পারবো না?
না আপনি পারবেন না। আপনার সেই সাহস নেই, সেই ক্ষমতা নেই। এই যে আমি আপনার এত কাছে বসে আছি–আপনার যদি ইচ্ছেও করে আপনি আমার হাত ধরতে পারবেন না।
পুষ্প।
জি।
আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি তুমি সত্যি জবাব দেবে?
পুষ্প বলল, আমি কখনো, কোনদিনও আপনার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলব না। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি।
কখন প্রতিজ্ঞা করলে?
যেদিন আপনাকে প্রথম দেখলাম সেই দিন। যেদিন পা ছুঁয়ে সালাম করলাম।
ভালবাসা সম্পর্কে আমার একটি থিওরী আছে তুমি কি শুনতে চাও?