শওকত সাহেব খুবই মন খারাপ করে লক্ষ্য করলেন ছেলেটি সত্যি সত্যি সবার পেছনে কানে ধরে চুপচাপ বসে আছে। তিনি এই স্কুলে আসার কারণে বাচ্ছ একটি ছেলে লজ্জিত ও অপমানিত হল।
অনুষ্ঠান শেষে হেডমাস্টার সাহেব ঘোষণা করলেন–মহান অতিথির এই স্কুলে পদাৰ্পন উপলক্ষ্যে আগামী বুধবার স্কুল বন্ধ থাকবে।
আজ লিখতে খুব ভাল লাগছে
আজ লিখতে খুব ভাল লাগছে।
কলম চলছে দ্রুত গতিতে। আকাশ মেঘলা। অল্প অল্প বাতাস দিচ্ছে। সেই বাতাসে বজরা দুলছে। এই দুলুনীর সঙ্গে কোথায় যেন লেখার খানিকটা মিল আছে। ঘুঘু ডাকছে। ঘুঘু নামের এই বিচিত্র পাখি সকালে বা সন্ধ্যায় কেন ডাকে না? বেছে বেছে ক্লান্ত দুপুরে ডেকে দুপুরগুলিকে কেমন অন্য রকম করে দেয়। | প্রকাণ্ড এক ছাতিম গাছের গুড়ির সঙ্গে নৌকা বাঁধা। বজরার জানালা থেকে ছাতিম গাছের ডালপালা এবং তার ফাঁক দিয়ে দূরের আকাশ দেখা যায়। শওকত সাহেব লেখা থামিয়ে ছাতিম গাছটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার হঠাৎ মনে হল–বৃক্ষরাজি সব সময় আকাশ স্পর্শ করতে চায়। তারা সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। মানুষ চায় মাটি এবং জলের কাছাকাছি থাকতে। তিনি খুব কম মানুষকেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছেন–।
স্যার আপনের খাওয়া।
বাবু টিফিন ক্যারিয়ার হাতে উঠে এসেছে।
তিনি আকাশের কাছ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। বাবু হাঁটুর উপর লুঙ্গী তুলে কালো গেঞ্জী গায়ে চলে এসেছে। কি কুৎসিত ছবি।
আজ স্যার গোমাংস। বৃষ্টি বাদলার দিনতো খাইয়া আরাম পাইবেন। ধুম বৃষ্টি হইব, আসমানের অবস্থা দেখেন।
তুমি টিফিন ক্যারিয়ার রেখে যাও। আমি খেয়ে নেব।
উপস্থিত থাইকা আপনেরে খাওয়াইতে বলছে।
কে বলেছে। পুষ্প?
পুষ্প ছাড়া আর কে? শেষ বাটির মধ্যে দৈ মিষ্টি আছে।
তুমি খেয়েছ?
জ্বি না। আপনের খাওয়া শেষ হইলে পুষ্প আর আমি খাইতে বসব।
আজ তিন দিন হল পুষ্পের সঙ্গে তার দেখা নেই। তার পক্ষে কাদা ভেঙ্গে বজরায় আসা অবশ্যি কষ্টকর, তবু ইচ্ছে করলে সে কি আর আসতে পারত না? অবশ্যই পারত।
স্যার কি মঠ দেখতে গেছিলেন?
হ্যাঁ।
আমি গতকাল পুষ্পেরে নিয়া গেলাম। ঢুকলাম ভিতরে। পুষ্প না করতেছিল–সাপখোপ থাকতে পারে। আমি বললাম, ভয়ের কিছু নাই। আমি সাপের বাবা সর্পরাজ। হা-হা-হা।
কি দেখলে?
আরে দূর দূর–কিছু না–শিয়ালের গু ছাড়া কিছু নাই।
শওকত সাহেব দীৰ্ঘ নিশ্বাস ফেলে খেতে বসলেন। যত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করা যাবে তত তাড়াতাড়ি এই আপদ বিদেয় হবে।
স্যার আইজ কয় পৃষ্ঠা লেখলেন?
লিখেছি কয়েক পৃষ্ঠা।
লেখা শেষ?
না। কিছুটা বাকি আছে।
এত লেখালেখি করেন আঙুল ব্যাখ্যা করে না?
তিনি চুপ করে রইলেন। কথাবার্তা চালানোর কোন অর্থ হয় না।
আমি স্যার পরীক্ষার হলে তিন ঘন্টা লেখি তারপরে আঙুলের যন্ত্রণায় অস্থির হই। আঙুল যদি দাঁতের মত বাঁধানোর ব্যবস্থা থাকত তা হইলে লেখকরা সব আঙুল বাধিয়ে ফেলত। কেউ রূপা দিয়া কেউ সোনা দিয়া। ঠিক বললাম না। স্যার?
হ্যাঁ ঠিক।
আপনে কি দিয়া বাঁধাইতেন? সোনা না রূপা?
বাবু।
জি।
খাওয়ার সময় কথা বলতে আমার ভাল লাগে না।
জানতাম না স্যার।
কথা শুনতেও ভাল লাগে না।
আর কথা বলব না স্যার। কি লেখলেন একটু পইড়া দেখি।
না। লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কাউকে পড়তে দেই না।
বাবু দীৰ্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পড়লেও কিছু বুঝব না। স্যার আপনি—লালুভুলু পড়েছেন? একটা হীট বই–চোখের পানি রাখা মুশকিল। আমি যতবার পড়ি ততবার কাঁদি।
শওকত সাহেব খাওয়া বন্ধ করে উঠে পড়লেন।
খাওয়া হয়ে গেল?
হুঁ।
কিছুই তো খান নাই। গো-মাংস ভাল লাগে না স্যার?
লাগে। আজ খেতে উচ্ছা করছে না। তুমি এখন টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে যাও।
জি আচ্ছা।
শওকত সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি পুষ্পকে একবার এখানে আসতে বলতো।
কখন আসতে বলব, এখন?
এক সময় এলেই হবে।
সন্ধ্যার সময় আমি সাথে করে নিয়ে আসব। কোন অসুবিধা নাই।
থাক সন্ধ্যায় আসার দরকার নাই। আমার কাজ বাকি আছে।
বাবু বজরা থেকে নেমে আবার উঠে এল।
আসল কথা, বলতে ভুলে গেছি। আপনার চিঠি আসছে। এই যে নেন।
একটিমাত্র চিঠি তাও রে লিখেনি। লিখেছে স্বাতী।
বাবা,
অনেকদিন তোমাকে দেখি না।
তুমি কবে আসবে?
তুমি কি আমার সঙ্গে রাগ করেছ? মা বলেছে–পৃথিবীর সবার সঙ্গেই তোমার রাগ। আচ্ছা বাবা পৃথিবী বানান কি ঠিক হয়েছে?
মাকে জিজ্ঞেস করলাম পৃথিবী বানান। মা বলল তোমার যা ইচ্ছা লেখ। আমি কিছু জানি না। বাবা তোমার বই লেখা শেষ হয়েছে? আমার একটা দাত পড়েছে। আমি রেখে দিয়েছি–তুমি এলে দেখাব। মার কাছে লেখা তোমার চিঠি আমি লুকিয়ে পড়েছি।
ইতি
তোমার আদরের মেয়ে, স্বাতী।
চিঠিতে কিছুই নেই অথচ শওকত সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ চিঠির জবাব লিখতে বসলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে স্বাতীকে কিছু লিখলেন না। লিখলেন রেনুকে।
রেণু,
স্বাতীর চিঠি পেয়েছি। খামের উপর তোমার হাতের ঠিকানা দেখে ভাবলাম তোমাৰ চিঠি। চিঠি লিখছ না কেন বল তো? এক সময় তুমি তোমার রাগ এবং অভিমানের কারণগুলি আমাকে বলতে। দীর্ঘ দিন সেই সব বলা বন্ধ করেছ। কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। না-কি সুর কখনোই ছিল না, আমরা ভেবে নিয়েছি সুর আছে। একটা সময় ছিল–আমার অর্থবিত্ত ছিল না, খ্যাতি ছিল না, ক্ষমতা ছিল না, লেখার একটা কলম ছিল। আর ছিলে তুমি। তখন প্রায়ই ভাবতাম কোনটি আমার প্রিয় কলমটা না তুমি?