কিছু না বললে খারাপ দেখা যায় বলেই শওকত সাহেব বললেন, কি ভাল?
জি স্যার ভাল। একটু দোয়া রাখবেন। জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছি আজ নয় বছর। বদলির জন্যে চেষ্টা কম করি নাই। অনেক ধরাধরি করেছি–লাভ হয় নাই। মফস্বল থেকে চিঠি গেলে এরা স্যার ফেলে দেয়। খাম খুলে পড়েও না।
প্রসঙ্গ ঘুরাবার জন্য শওকত সাহেব বললেন, স্টেশন ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বিরাট একটা গাছ দেখলাম। কি গাছ এটা?
এটা স্যার শিরীষ গাছ। গত বৈশাখ মাসে ঐ গাছের ডাল ভেঙ্গে স্টেশন ঘরের উপরে পড়ল। ঘর জখম হয়ে গেল। বৃষ্টি বাদলা হলে ঘরে পানি ঢুকে। রিপেয়ার করার জন্য এই পর্যন্ত দুটা চিঠি লিখেছি–কোন লাভ নাই। ওদের স্যার মফস্বলের জন্য আলাদা ফাইল আছে। চিঠি গেলেই ঐ ফাইলে রেখে দেয়। খুলেও পড়ে না। স্যার, সিগারেটটা ধরান, আপনার জন্য আনিয়েছি।
শওকত সাহেব সিগারেট ধরলেন। স্টেশন মাস্টার বললেন, গোল্ড লীফ ছাড়া ভাল কিছু পাওয়া যায় না। বেনসন আনতে পাঠিয়েছিলাম। পায় নাই। মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়। দামী সিগারেট খাওয়ার লোক কোথায়? সবাই হত দরিদ্র।
শওকত সাহেব দীৰ্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, এই অঞ্চলের সবাই বেশী কথা বলে? যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে সেই কথা বলছে। অনবরত কথা বলছে। ভাগ্যিস মোফাজ্জল করিম সাহেব নেই। তিনি নৌকার খোঁজ খবরে গেছেন। তিনি থাকলে দুজনের মধ্যে কথা বলার কম্পিটিশন শুরু হয়ে যেত। মোফাজ্জল করিম সাহেব সম্ভবত জিততেন। মাস্টারদের সঙ্গে কথা বলায় কেউ পারে না।
স্যার কত দিন থাকবেন এখানে?
ঠিক করিনি। পনেরো বিশ দিন থাকব।
শুনলাম, নির্জনে একটা লেখা শেষ করার জন্য এসেছেন?
শওকত সাহেব দীৰ্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। নির্জনতার যে নমুনা শুরু হয়েছে খুব বেশী ভরসা করতে পারছেন না।
স্যার পান খেলেন না?
পান আমি খাই না। থ্যাংক ইউ। আমি বাইরে একটু দাঁড়াই।
বাইরে দাঁড়ায়ে কি দেখবেন স্যার, কিছুই দেখার নাই। শীতকালে তাও একটু হাঁটাহাঁটি করা যায়–বর্ষাকালে অসম্ভব। কাঁচা রাস্তা, হাঁটু পর্যন্ত কাদা। দিনরাত বৃষ্টি। খাওয়া খাদ্য কিছু নাই। ইলিশ মাছ এক জিনিস দুই বছরে চোখে দেখি নাই। তরকারীর মধ্যে আছে উঁটা, পুই শাক আর ঝিঙ্গা। এই তিন জিনিস কত খাওয়া যায় বলেন? পটল এক জিনিস কেউ চোখেও দেখে নাই। অথচ শহর বন্দরে এই জিনিস খাওয়ার লোক নাই।
শওকত সাহেব স্টেশন ঘর থেকে বের হয়ে এলেন আর তখনি কেঁপে বৃষ্টি এল। শিরীষ গাছের ঘন পাতায় বৃষ্টি আটকে যাচ্ছে। কতক্ষণ এ রকম থাকবে কে জানে। শওকত সাহেব মুগ্ধ হয়ে গাছ, বৃষ্টি এবং দূরের মাঠ দেখতে লাগলেন। সামনের অনেকখানি ফাঁকা। দৃষ্টি অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়া যায়। শহরের সঙ্গে গ্রামের এই বোধ হয় তফাৎ। শহরে দৃষ্টি আটকে যায়। গ্রামে আটকায় না।
ছাতা মাথায় মোফাজ্জল করিমকে হন হন করে আসতে দেখা যাচ্ছে। পায়ের জুতা জোড়া খুলে তিনি হাতে নিয়ে নিয়েছেন। প্যান্ট ভাজ করে হাঁটু পর্যন্ত তুলে দিয়েছেন। শওকত সাহেব আঁৎকে উঠলেন, তাকেও কি এইভাবে যেতে হবে? বৃষ্টির জোর খুব বেড়েছে। শিরীষ গাছের একটি মাত্র ডালে ছসাতটা কাক বসে বসে ভিজছে। অন্য ডালগুলি কঁকা। কাকরা কি একটি বিশেষ ডাল বৃষ্টির সময় আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করে। এই ডালটার নিশ্চয়ই কোন সুবিধা আছে।
স্টেশন মাস্টার সাহেবও ছাতা হাতে বের হয়েছেন। তিনি নিজেই ছাতা মেলে শওকত সাহেবের মাথার উপর ধরলেন। বিরক্ত মুখে বললেন, এই যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে খুব কম করে হলেও সাতদিন থাকবে।
শওকত সাহেব বললেন, একটা মজার জিনিস দেখুনতো। এতগুলি ভাল থাকতে কাকরা সবাই একটা ডালে বসে আছে কেন?
পশু পাখির কি স্যার কোন বুদ্ধিশুদ্ধি আছে? একজন একটা ডালে বসছে। গুষ্ঠিশুদ্ধা সেই ডালে গিয়ে বসছে। স্যার ভিতরে চলেন। বৃষ্টিতে ভিজতেছেন।
আপনি ছাতাটা আমার হাতে দিয়ে চলে যান। বৃষ্টি দেখতে আমার ভালই। লাগছে।
একদিন দুদিন লাগবে স্যার। তারপর দেখবেন যন্ত্ৰণা। গ্রামদেশে সবচে খারাপ সময় হইল বর্ষাকাল।
মোফাজ্জল করিম সাহেব একটা চায়ের দোকানে দাড়িয়ে কি যেন কিনলেন, তারপর আবার যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকে রওনা হলেন। শিরীষ গাছের ঐ ডালটায় আরো কিছু কাক এসে বসেছে। অন্য ডালগুলি এখনো কঁকা। যখন ঝড়-বৃষ্টি থাকে না তখন এরা কি করে? অন্য ডালগুলিতে বসে? নাকি কখনো বসে না? প্রচণ্ড শব্দে কাছে কোথাও বজ্রপাত হল। ধক করে বুকে ধাক্কা লাগল। এত বড় শব্দ অথচ কাকদের মধ্যে কোন রকম চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেল না। সম্ভবত তারা শব্দটা কি, কখন হবে, কোথায় হবে জানে বলেই চুপচাপ আছে। আরো দুটা কাক এসে সেই ডালটাতেই বসল। আশ্চৰ্যতো!
নৌকা বেশ বড়।
ভেতরে তোষকের বিছানায় রঙিন চরি। দুটা বালিশ, একটা কোলবালিশ। মোফাজ্জল করিম বললেন, বিছানা বালিশ সব বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি। আরাম করতে করতে যাবেন।
শওকত সাহেব বললেন, কোলবালিশ এনেছেন কেন?
ঘরে ছিল। নিয়ে এসেছি।
তিনি যে শুধু কোলবালিশ এনেছেন তা না, টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবারদাবার নিয়ে এসেছেন। নৌকার চুলায় সেই সব খাবার গরম করা হচ্ছে। দুপুরের খাওয়া শেষ করে নৌকা ছাড়া হবে।
বৃষ্টির তেজ অনেক কমেছে। ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। তবে বাতাস আছে।
করিম সাহেব বললেন, এই বৎসর মারাত্মক বন্যা হবে। কি বলেন স্যার?