ঐ যে আসছেন বাবু ভাই।
সে কি প্রায়ই আসে?
জে আসেন।
পুষ্প গল্প করলে রান্নাবান্না কে করছে?
মতির মা চইল্যা আসেছে।
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাও।
তিনি রানুর কাছে লেখা চিঠিটি আবার পড়লেন এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন চিঠির কোথাও পুষ্পের কথা নেই। রানু এই চিঠি পড়ে বুঝতেও পারবে না এ বাড়িতে পুষ্প নামের রূপবতী একটি মেয়ে আছে। তিনি এই কাজটি কেন করলেন? ইচ্ছাকৃতভাবে করেন নি। অবচেতন মন তাকে বাধা দিয়েছে।
স্যার আসব?
শওকত সাহেব দেখলেন দরজার কাছে বাবু দাড়িয়ে। পান খেয়ে ঠোট লাল। করে এসেছে।
আপনার সাথে পরিচয় করবার জন্য আসলাম। আপনাদের মত মানুষের দেখা পাওয়া আর হাতে আসমানের চান পাওয়া এক কথা।
আমাকে তুমি চেন?
জি না–পুষ্প আমারে বলেছে।
তাকে ভেতরে আসার কথা বলতে হল না। সে নিজ থেকেই ঘরে ঢুকে পালঙ্কে পা তুলে বসল। তার মধ্যে অপরিচিত একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলার প্রাথমিক সংকোচটুকুও পুরোপুরি অনুপস্থিত।
তুমি কি পড়াশোনা কর?
জি। বি, এ দিছিলাম–রেফার্ড হয়ে গেল। অবশ্য আই এ একচাপ্সে পাশ। করেছি।
এস, এস, সি এক চান্স পার নি?
জ্বি না। এস, এস, সি এক চান্সে পাশ করা খুবই কঠিন ব্যাপার। জুয়েল ছেলেমেয়েরা পারে।
তুমি নিজেকে জুয়েল মনে করে না?
আরে না। কি যে স্যার আপনে বলেন।
পাশ করার পর কি করবে চাকরি বাকরি?
চাকরি বাকরি আমারে কে দিবে? তারপরেও ধরেন যদি ভুল করে কেউ দেয় তা হইলেও তো সাড়ে সর্বনাশ।
সাড়ে সর্বনাশ কেন?
লেখাপড়া কিছুই জানি না। আই এ তে তাও কিছু পড়েছিলাম। বি, এতে কিছুই পড়ি নাই। নকলের উপর পাশ করেছি। এইবার বাইরে থাইক্যা খুব ষ্ট্যাণ্ডার্ড নকল আসছে।
তারপরেও রেফার্ড পেয়ে গেলে?
না পাইয়া উপায় কি বলেন–ঐ দিন হঠাৎ ম্যাজিষ্ট্রেট আইস উপস্থিত। সাপ্লাই বন্ধ। এই এক পেপারে আমার সর্বনাশ হইছে। অন্য গুলোয় ফিফটি ওয়ান পার্সেন্ট নম্বর আছে।
নাম্বারতো খুব ভাল পেয়েছ।
আপনারে কি বললাম স্যার খুব ষ্ট্যাণ্ডার্ড নকল ছিল এই বৎসর। ভেরি হাই স্ট্যান্ডার্ড।
পাশ করে কি করবে তা কিন্তু এখনো বলনি—
আমাদের মত ছেলেদের ব্যবসা ছাড়া গতি কি বলেন। বাবার একটা ফার্মেসী আছে নেত্রকোনা সদরে–আল মদিনা ড্রাগ ষ্টোর। ঐটা দেখাশোনা করব। আপনে স্যার আমার জন্য দোয়া রাখবেন। আপনি জ্ঞানী মানুষ। পুষ্প যে সব কথা আপনার সম্বন্ধে বলল, শুনে চোখে পানি এসে গেল।
শওকত সাহেব চুপ করে বসে রইলেন। পুষ্প তাঁর সম্পর্কে এমন কি বলতে পারে যে বাবু নামের এই ছেলের চোখে পানি এসে যায়।
পুষ্প কি বলেছে আমার সম্পর্কে?
ঐ যে স্যার ঝড়ের মধ্যে পড়লেন–তারপর ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেল–খালি উল্টাপাল্টা কবিতা! স্যার এখন তাহলে যাই। স্লামালিকুম।
তিনি সালামের উত্তর দিলেন না। উত্তর দেবার মত অবস্থা তার ছিল না। তিনি পুরোপুরি হতভম্ব।
শওকত সাহেব বজরায় বাস করছেন
গত দুদিন ধরে শওকত সাহেব বজরায় বাস করছেন।
প্রথম রাতে বেশ অস্বস্তি লেগেছে। বজরার দুলুনি ঠিক সহ্য হয়নি। বজরা দুলছিল না। কিন্তু তাঁর কাছে মনে হচ্ছিল খুব সূক্ষ্মভাবে দুলছে। নদীর জলস্রোতের শব্দও মনে হল মাথায় চাপ ফেলছে। দ্বিতীয় দিনে সব অস্বস্তি দূর হয়ে গেল। মনে হল রাত্রি যাপনের এরচে ভাল কিছু থাকতে পারে না।
বজরাটা চমক্কার বসার ঘর, শোবার ঘর। খুব সুন্দর বাথরুম। ভেতরের চেয়ে বাইরের ব্যবস্থা আরো ভাল। ছাদের উপর আরাম কেদারা। আরামকেদারার। পাশে টেবিল। আরাম কেদারায় শুয়ে পা দুটিও যাতে খানিকটা উঁচুতে রাখা যায় তার জন্যে ছোটু টুল যার নাম পা-ঢুল।
করিম সাহেব আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে বললেন, স্যার ব্যবস্থা কেমন?
ব্যবস্থা ভাল।
স্যার পছন্দ হয়েছে তো?
হয়েছে।
তাহলে স্যার ওসি সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে একটা চিঠি দিয়ে দিবেন। উনি খুব খুশী হবেন। লোক ভাল।
আমি চিঠি দিয়ে দেব।
উনি জিজ্ঞেস করছিলেন, উনার বাসায় চায়ের দাওয়াত দিলে আপনি কবুল করবেন কি-না। উনার খুব শখ।
হ্যাঁ যাব। চা খেয়ে আসব।
আরেকটা কথা স্যার, ময়নাতলা স্কুলে একদিন যাওয়া লাগে।
ঐখানে কি ব্যাপার?
কিছুই না। টিচারদের সাথে চা-পানি খাবেন। ছাত্রদের দুই একটা কথা বলবেন।
সেটা কবে?
এই সোমবারে। মহাপুরুষদের কথা শুধু শুনলেই হয় না। চোখে দেখতেও হয়। এতে পুণ্য যেমন হয়–তেমনি ….
শওকত সাহেব কথা শেষ করতে দিলেন না, বললেন, আমি যাব। আমাকে দেখলে যদি আপনার ছাত্রদের পূণ্য হয় তাহলে তোক কিছুটা পুণ্য।
ওসি সাহেবের বাসায় চায়ের দাওয়াত রাতের খাবারে রূপান্তরিত হল। পোলাও কোৰ্মার সমারোহ। প্ৰকাণ্ড কাতল মাছের মাথা বিশাল একটা থালায় সাজিয়ে। শওকত সাহেবের সামনে ধরা হল। ও সি সাহেব হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, স্যার আপনার জন্য মাছটা মোহনগঞ্জ থেকে আনা হয়েছে।
শওকত সাহেব বললেন, মাছের মাথাতে আমি খাই না। কখনো না।
না খেলেও। এর উপর হাতটা রেখে একটু তাকিয়ে থাকুন। কেন?
ছবি তুলব স্যার।
তিনি তাই করলেন। তিন দিক থেকে তিনবার ছবি তোলা হল। শুধু মাছের মাথার সঙ্গে ছবি না, ওসি সাহেবের সঙ্গে ছবি, তার স্ত্রীর সঙ্গে ছবি, ওসি সাহেবের ছেলের সঙ্গে ছবি এবং শেষ পর্যায়ে ওসি সাহেবের শালাকে পাশে নিয়ে ছবি।
ছবি তোলার পূর্ব শেষ হবার পর ওসি সাহেবের স্ত্রী একটি দীর্ঘ কবিতা। পড়লেন। অঁকে উদ্দেশ্য করেই নাকি কবিতাটি লেখা হয়েছে। যদিও শওকত সাহেব সেই দীর্ঘ কবিতায় তার অংশ কি আছে কিছুই বুঝলেন না।