ও আচ্ছা।
সেঁজুতখালির হাটে আজে-বাজে গরু জবেহ করে। বাছা-বাছা গরু জবেহ হয় হলদিয়া হাটে। সোমবারে হাট আছে। আমি নিজেই যাব। তবে সেঁজুতখালির হাটে মাঝে মধ্যে ভাল গোশত পাওয়া যায়–এখন দেখি আপনার ভাগ্য।
গোশত কেমন তা দিয়ে আমার ভাগ্য বিচার করবেন?
ছিঃ ছিঃ স্যার এটা কি বললেন? আমি একটা কথার কথা বলেছি।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল। উঠোনে জলচৌকি পেতে কে একজন বসে আছে। বারান্দায় একটা বেতের ঝুড়ি এবং একটা সুটকেস। যে বসে আছে তার বয়স বাইশ তেইশ। বেঁটেখাট একজন যুবক। বেশ স্বাস্থ্যবান। মনে হচ্ছে সম্প্রতি গোফ রেখেছে। গোঁফের পেছনে অনেক যত্ন এবং সাধনা। আছে তা বোঝা যাচ্ছে।
তাকে দেখেই পুষ্প দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠল ওমা বাবু ভাই। বাবু ভাই তুমি কোত্থেকে?
শওকত সাহেব লক্ষ্য করলেন, বাৰু ভাই নামধারী যুবক এই উদ্যাসের প্রতি বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেখাল না। যেন সে ধরেই নিয়েছে তাকে দেখামাত্র এমন রূপবতী একটি মেয়ে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠবে।
করিম সাহেব বললেন, ও আমার দূর সম্পর্কের ভাগ্নে হয়। পুষ্পের সঙ্গে তার খুব ভাব।
শওকত সাহেব বললেন, ও আচ্ছা।
তিনি দোতলায় উঠে এলেন। রেনুকে আরেকটা চিঠি লেখা দরকার। প্রথম চিঠিটিও পাঠানো হয় নি। আশ্চর্য ব্যাপার এখানে এসে পা দেয়ার পর রেণুর কথা তাঁর মনে হয় নি। স্বাতীর কথাও না। যেন ঐ জীবন তিনি পিছনে ফেলে এসেছেন। সেখানে ফিরে যাবার আর প্রয়োজন নেই।
তিনি জানালার পাশে দাড়িয়ে আছেন। এখান থেকে কুয়োতলাটা দেখা যাচ্ছে। পুষ্প কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে–ঐ ছেলেটি কি যেন নাম–বাবু। হ্যা বাবু, বালতি বালতি পানি তুলে পুষ্পের পায়ে ঢালছে। কিছু বোধ হয় বলছেও–কারণ পুষ্প কিছুক্ষণ পর পর খিল খিল করে হেসে উঠছে। আশ্চর্য, এত আনন্দিত হয়েছে মেয়েটা? তিনি কি কখনো কাউকে এত আনন্দিত করতে পেরেছেন?
শওকত সাহেবের মনে পড়ল কাদা পায়েই তিনি তাঁর ঘরে ঢুকেছেন। সারা ঘর কাদায় মাখামাখি। তিনি ঘর ছেড়ে বাথরুমে ঢুকলেন। দীর্ঘ সময় নিয়ে গা ধুলেন। কাজটা বোধ হয় ঠিক হল না। আবার জ্বর না এলে হয়।
গোসল শেষ করে ঘরে ঢুকে দেখেন ময়নাল স্কুলের দপ্তরি ইউনুস মিয়া ঘরে কেরোসিন ল্যাম্প জ্বালাচ্ছে।
ইউনুস মিয়া!
জি স্যার।
কাদা-পায়ে ঘরে ঢুকে ঘরের অবস্থা কি করেছি দেখ। একটু পরিষ্কার করে দিবে?
দিতাছি স্যার।
নীচে গিয়ে পুস্পকে বলবে এক কাপ চা দিতে?
জি স্যার, বলছি।
তোমার কি মনে হয়–আজ রাতে বৃষ্টি হবে?
এইটা স্যার ক্যামনে বলব? আল্লাহতালার ইচ্ছার উপরে সব নির্ভর।
তা ঠিক।
শওকত সাহেব লেখার টেবিলে বসলেন। রেনুকে চিঠি লিখতে হবে। ভাগিস চশমার কাছে ডান হাত কাটে নি। ডান হাত কাটিলে কিছুই লিখতে পারতেন না। বা হাতে যন্ত্রণা হচ্ছে। সারাদিন এই যন্ত্ৰণা টের পাননি কেন?
কল্যাণীয়া,
রানু, প্রথম চিঠি (যা নৌকায় লেখা) তোমাকে পাঠাতে পারি নি। এর মধ্যে দ্বিতীয় চিঠি লেখা হল। দুটোই এক সঙ্গে পাঠাচ্ছি। এখানে কেমন আছি তা বলে লাভ নেই। ভাল আছি। মহাকবি বজলুর রহমান যেমন বলেছেন–বাড়ি তেমন নয় তাতো বুঝতেই পারছ। তবু খারাপ না। মোফাজ্জল করিম সাহেব যত্নের চূড়ান্ত করছেন। আলাদা বাবুচির ব্যবস্থা করা যায় নি। শুরুতে বেশ কয়েকবার বলেছি–অজ পাড়াগাঁয় তা বোধ হয় সম্ভবও নয়।
এখানকার বর্ষা খুব enjoy করছি। এর মধ্যে ঝড়ের মধ্যে পড়েছিলাম। অনেকদিন পর ছেলেবেলার মত বৃষ্টিতে ভিড়লাম। সেই রাতে একটু জ্বরের মত হয়েছিল। তুমি এই খবরে আঁৎকে উঠবে না। এমন জ্বর–যা থার্মোমিটারেও মাপা যায় না। এখন তোমার বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ–তুমি অষ্টাঙ্গ সহ বলে একটি বই সুটকেসে ঢুকিয়ে দিয়েছ। আমার যতদূর ধারণা এইসব বই সাধু সন্ন্যাসীদের জন্যে। তুমি কি ভাবছ আমি সন্ন্যাসী হবার জন্যে এখানে এসেছি? অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি। পড়লেই বুঝবে কি জিনিস পাঠিয়েছ—
যে ব্যক্তি সপ্তৰ্ষি মণ্ডলের সীমান্তে অরুন্ধতী নক্ষত্র দেখতে পায় না সেই ব্যক্তি এক বৎসর পর মৃত্যু বরণ করে।
ভক্তি, সদাচার, স্মৃতি, দানশীলতা, বুদ্ধি ও বল এই ছয়টি গুণ যাহার নষ্ট হয় তাহার মৃত্যু হয় মাসের মধ্যে ঘটে।
বই পড়ার পর অরুন্ধতী নক্ষত্র দেখার চেষ্টা করে বিফল হয়েছি–কাজেই ভয়ে ভয়ে আছি। ছয়টি সগুণের মধ্যে মাত্র দুটি–বুদ্ধি ও স্মৃতি এখনো আছে। এই দুটি চলে গেলে কি যে হবে কে জানে।
এতক্ষণ রসিকতা করলেও মৃত্যু নিয়ে আমি কিন্তু প্রায়ই ভাবি। এতদিন যা লিখেছি তার কিছু কি টিকে থাকবে? তীর ছেলেমেয়েরা কি পড়তে পারবে, না তার আগেই সব শেষ? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–
আমার কীৰ্তিরে আমি করি না বিশ্বাস।
জানি, কাল সিন্ধু তারে
নিয়ত তরঙ্গাঘাতে
দিনে দিনে দিবে লুপ্ত করি।
সেখানে আমি কে?
আজ এই পর্যন্তই।
পুনশ্চঃ আমার স্মৃতিশক্তি যে এখনো আছে–কবিতার চারটি চরণ লিখে তা প্রমাণ করলাম। কাজেই আরো কিছু দিন টিকে থাকব। কি সৰ্বনাশ, আসল খবর দিতে ভুলে গিয়েছি লেখা খুব ভাল এগুচ্ছে–পঁয়ত্রিশ পৃষ্ঠা লিখে ফেলেছি।
স্যার আপনের চা।
চা নিয়ে এসেছে। ইউনুস মিয়। শওকত সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি কি মনে মনে আশা করছিলেন পুষ্প আসবে?
ইউনুস মিয়া।
জে।
পুষ্প কি করছে?
গল্প করতেছেন।
কার সঙ্গে?