না।
স্যার আমি কি আপনার নাশতা নিয়ে আসব?
নিয়ে আস।
মেয়েটিকে প্রচণ্ড ধমক দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। বলতে ইচ্ছা করছে–শোন বোকা মেয়ে, আমি এই পৃথিবীটাকে যেমন দেখি, যেমন ভাবি তেমন করেই লিখি। সত্যিকার পৃথিবীটা কেমন তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। সত্যিকার ছবি হচ্ছে ফটোগ্রাফী। সাহিত্য ফটোগ্রাফী নয়, তৈলচিত্র। সেই তৈলচিত্রে আমি কিছু রঙ বেশী ব্যবহার করেছি। মানুষকে যেভাবে দেখতে ভালবাসি আমি সেইভাবে আঁকি। যদিও জানি মানুষ সে রকম নয়। আমি নিজেও তেমন নই। কিন্তু আমার সে রকম হতে ইচ্ছে করে। কাজেই আমি ধরে নিয়েছি অন্যদেরও তাই হতে ইচ্ছে করে। আমি মানুষের ইচ্ছের ছবি এঁকেছি।
এইসব কথার কিছুই বলা হল না। তিনি নিঃশব্দে নাশতা খেলেন। নাশতা শেষ করে লেখার টেবিলে গিয়ে বসলেন। পুষ্প পেছনে পেছনে এল।
কিছু বলবে পুষ্প?
পুষ্প নরম গলায় বলল, আপনি আমার কথায় এতটা মন খারাপ করবেন। আমি ভাবি নি। আমি অতি সামান্য মেয়ে, আমার কথার কি গুরুত্ব আছে।
আমার সহজে মন খারাপ হয় না। কঠিন আঘাতও আমি সহজভাবে গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু এই বইটির ব্যাপারে আমার এক ধরনের স্পর্শকাতরতা। আছে। লেখক হিসেবে আমার আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রথম বইটি প্রকাশিত হবার পর তিন বছর একটি লাইন লিখতে পারিনি। তারপর এই বইটি লিখলাম। লেখার পর মনে হল নিজের স্বপ্ন অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা আমার আছে। হোক না স্বপ্নটা মিথ্যা।
আপনি নিজে যদি এটা বিশ্বাস করেন তাহলে আমার উপর এত রাগ করলেন কেন?
তোমার উপর রাগ করেছি কারণ তুমি আমাকে যা বলেছে তাও কিন্তু আমি বিশ্বাস করি।
তা কেমন করে হয়?
হয়। একই সঙ্গে আমরা ভালবাসি, আবার যাকে ভালবাসি তাকে ঘৃণাও করি। তুমি সম্ভবত এখনো কারো প্রেমে পড়নি। প্রেমে পড়লে বুঝতে পারতে।
আপনি কি এখন লিখবেন?
হ্যাঁ।
লেখার সময় আমি যদি পাশে বসে থাকি আপনি কি রাগ করবেন?
আমি চাই না লেখার সময় কেউ আমার আশে-পাশে থাকে। লিখতে লিখতে প্রায়ই আমার চোখে পানি আসে। এই দৃশ্য অন্যের কাছে হাস্যকর মনে হবারই কথা।
তাহলে আমি যাই।
আচ্ছা যাও–ভাল কথা, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। Young lady, you are smart. এখন যাও আমি লেখা শুরু করি।
আজও কি দুপুরে খাবেন না?
খাব। এখানে খাবার আনতে হবে না। ঠিক দুটার সময় আমি তোমাদের ঘরে আসিব।
বিকেলে কি আমার সঙ্গে মঠটা দেখতে যাবেন?
যাব।
সত্যি যাবেন?
হ্যাঁ, সত্যি যাব।
মঠ ব্যাপারটা আসলে ইটের বিশাল স্তূপ।
বোঝা যাচ্ছে এক সময় অনেক উঁচু ছিল, এখন ভেঙ্গে একাকার হয়ে আছে। চল্লিশ পঞ্চাশ ফিটের মত উঁচু। উপরে উঠার সিড়ি আছে। মোফাজ্জল করিম সাহেবও সঙ্গে আছেন। তিনিই সবচে অবাক হলেন, এইটা কি ব্যাপার? জিনিসটা কি?
শওকত সাহেব বললেন, আপনি কখনো আসেন নি?
আসবে না কেন? এই রাস্তায় কত আনাগোনা করেছি। জঙ্গলের ভিতর কখনো ঢুকি নাই। অবশ্য শুনেছি মঠের কথা।
পুষ্প বলল, বাবা সিঁড়ি দিয়ে উঠলে কেমন হয়?
করিম সাহেব আঁৎকে উঠলেন, পাগল হয়েছিস? এটা সাপের আড্ডাখানা। তার উপর বর্ষাকাল। কাছে পিছেই বেশীক্ষণ থাকা উচিত না।
শওকত সাহেব বললেন, জিনিসটা কি কেউ কি বলতে পারে? দেখতে অনেকটা বাতিঘরের মত। এই জায়গায় বাতিঘর থাকবে কেন? বৌদ্ধদের কিছু নাতো?
করিম সাহেব বললেন, না। এই অঞ্চলে কোন বৌদ্ধ নাই।
এরকম স্তূপ কি একটাই না আরো আছে?
জানি না তো।
খোঁজ নেয়া যায়?
অবশ্যই খোঁজ নেয়া যায়। স্কুলে একটা নোটিশ দিয়ে দিলেই হবে। দূর দূর থেকে ছেলেরা পড়তে আসে।
তাহলে একটা নোটিশ দিয়ে দেবেন তো? আমি খুবই অবাক হচ্ছি। জঙ্গলের ভেতর এমন বিশাল ব্যাপার দেখব আশা করিনি বলেই বোধ হয় অবাক হচ্ছি।
শীতকালে একবার আসবেন স্যার। আমি সব পরিষ্কার-টরিষ্কার করে রাখব। শীতকালে জায়গাটা এমিতেও খুব সুন্দর হয়। সোহাগী নদীর দুই ধারে কাশফুল ফোটে। আহ দেখার মত। চলেন স্যার, আজ ফেরা যাক। কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছেন।
চলুন।
আপনার জন্যে স্যার একটা ভাল খবর আছে।
বলুন শুনি।
ওসি সাহেবকে বলেছিলাম একটা বজরার ব্যবস্থা করতে। উনি খুবই করিকর্মা লোক। ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। সন্ধ্যার মধ্যে বজরা ঘাটে চলে আসবে।
শওকত সাহেব অবাক হয়ে বললেন, বজরা দিয়ে আমি কি করব?
বজরায় বসে লেখালেখি করবেন। ঘুরবেন।
আমি তো ভাই রবীন্দ্রনাথ না। আমি যেখানে আছি ভাল আছি।
সেটা তো স্যার রইলই। বজরাও রইল।
আগে আগে যাচ্ছেন করিম সাহেব, তার পেছনে শওকত সাহেব। পুষ্প এবং নৌকার মাঝি সবার পেছনে। পুষ্প নৌকার মাঝির সঙ্গে গল্প করতে করতে আসছে। চুল দুবেণী করায় তাকে খুকী-খুকী লাগছে। আজ সে সুন্দর একটা শাড়ি পরেছিল। কাদায় শাড়ির অনেকখানিই নষ্ট। কাদার দাগ উঠবে বলে মনে হয় না। শওকত সাহেব লক্ষ্য করলেন, পুষ্প মাঝির সঙ্গে ময়মনসিংহের স্থানীয় ভাষায় টেনে টেনে কথা বলছে। মাঝির মত করেই বলছে। করিম সাহেব যদিও তা করছেন না। ভাষার ব্যাপারে তিনি যে খুব সাবধান তা বোঝা যাচ্ছে।
করিম সাহেব বললেন, স্যার কি গোমাংস খান?
খাব না কেন?
অনেকে খায় না। এই জন্যে জিজ্ঞেস করছি। আমি লোক পাঠিয়েছি।
কোথায় লোক পাঠিয়েছেন?
এখানে তো স্যার গোমাংস পাওয়া যায় না। আশে-পাশে মাংসের দোকান নাই। হাটবারে গরু জবেহ হয়। আজ সেঁজুতখালির হাট। ঐখানে লোক পাঠিয়েছি।