পুষ্প এই কথার জবাব দিল না, আসল। মেয়েটি বুদ্ধিমতী–হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল সে রোজ এত ভোরে ওঠে না। মেয়েটি তার বাবার বকবকানির স্বভাব পায় নি–এও এক দিক দিয়ে রক্ষা। দুজনের কথা শুনতে হলে সৰ্বনাশ হয়ে যেত।
তোমার বাবা কি আছেন না স্কুলে চলে গেছেন?
স্কুলে গেছেন। আজ সকাল সকাল ফিরবেন। হাফস্কুল। বস পুষ্প, চা খেতে খেতে তোমার সঙ্গে গকরি।
বারান্দায় বসার কোন জায়গা নেই। একটি মাত্র চেয়ার সেখানে তিনি বসে আছেন।
শওকত সাহেব বললেন, টেবিটায় বস। আর টেবিলে যদি বসতে অসুবিধা হয় তাহলে ভেতর থেকে চেয়ার নিয়ে এসো। পুষ্প টেবিলেই বসল। তবে টেবিলটা একটু দূরে সরিয়ে নিল।
এখন বল তুমি কেমন আছ?
ভাল।
দেখে খুব ভাল মনে হচ্ছে না। রাতে ঘুম হয়নি তাই না?
পুষ্প হা সূচক মাথা নাড়ল। এই মানুষটার দৃষ্টি তীক্ষ। পুষ্প বলল, রাতে ঘুম হয়নি কি করে বুঝলেন?
চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম। রাতে ঘুম না হলে চোখের নীচ একটু কালচে হয়ে যায়। তোমার হয়েছে। তবে তুমি যদি এত ফশা না হতে হলে ধরতে পারতাম না। চা খুব ভাল হয়েছে।
আরেক কাপ দেই?
না। ভাল হয়েছে বলেই দ্বিতীয় কাপ খাব না। হয়ত দ্বিতীয়টা এত ভাল হবে না। সেই মন্দ চা খেয়ে প্রথম কাপের আনন্দ মাটি হবে। আচ্ছা এখন বল, তুমি আমার কোন লেখা পড়েছ?
একটা পড়েছি।
একটা? মোটে একটা?
জ্বি। আপনি আসবেন যখন কথা হল তখন বাবা নেত্রকোনা থেকে আপনার একটা বই কিনে আনলেন।
কোন বইটা কিনলেন?
বাবা দোকানদারকে বললেন, উনার সবচে কমদামী বই যেটা সেটাই দেন। দোকানদার একটা চটি বই দিয়ে দিল–প্রথম দিবস, দ্বিতীয় রজনী।
কমদামী বই, হলেও এটা আমার ভাল লেখার মধ্যে একটা। এই বই নিয়ে সুন্দর একটা গল্প আছে–দাঁড়াও তোমাকে বলি। বৈশাখ মাসের এক তারিখে বই বের হবার কথা। প্রকাশকের দোকানে সকাল থেকে বসে আছি। তখনতো আর আমার এত বই ছিল না—ঐটি হচ্ছে দ্বিতীয় বই। বই বেরুবে আমার আগ্রহ সীমাহীন। বাইডারের বই দেয়ার কথা সে আসছে না। দুপুরবেলা প্রকাশক বললেন, আপনি বাসায় চলে যান বই বের হলে আপনাকে বাসায় দিয়ে আসব। আমি রাজি হলাম না। এসেছি যখন বই নিয়েই যাব। বিকেল পর্যন্ত বসে রইলাম, বাইরের দেখা নেই। প্রকাশক বললেন, আপনি কাজ করুন বাইন্ডারের ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি–গিয়ে দেখুন কি ব্যাপার।
বাইন্ডারকে আওলাদ হোসেন লেনে ধরলাম। সে সবে মাত্ৰ লেই লাগাচ্ছে। আমার খুব মেজাজ খারাপ হল। বাইন্ডার বলল, কিছুক্ষণ বসেন একটা কাঁচা বই দিয়ে দেই।
সেই কিছুক্ষণ মানে চার ঘণ্টা। বাসায় ফিরলাম রাত নটার পর। বাসায় এসে দেখি–রেনুকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তার তখন নমাস চলছে। ডেলিভারী ডেটের এখনো অনেক দেরী। ব্যথা উঠে গেছে আগেই। ছুটে গেলাম হাসপাতালে। স্বাতীর জন্ম হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় তাকে মার পাশে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আমার লজ্জার সীমা রইল না। আমার প্রথম বাচ্চা অথচ আমি পাশে নেই। আমার লজ্জা এবং দুঃখ স্বাতী ঠিকই বুঝল। আমার লজ্জা ঢাকার জন্যে বলল, কই দেখি তোমার বই। বাহ কি সুন্দর। বলেই শুধু মাত্র আমাকে খুশী করার জন্যে এই
অবস্থায় বইটি পড়তে শুরু করল। আমার চোখে পানি এসে গেল।
পুষ্প বলল, আপনি এত সুন্দর করে গল্পটা বললেন যে আমার চোখেই পানি এসে গেছে।
রেনু অনেক বড় ভুল করে। নানান ভাবে আমাকে কষ্ট দেয় কিন্তু ঐ রাতের ঘটনার কথা মনে হলেই ওর সব অপরাধ আমি ক্ষমা করে দেই।
যে মেয়ে ঐ রাতে এমন কাড করতে পারেন তিনি ভুল করতে পারেন না।
তাও অবশ্যি ঠিক। এখন তুমি বল, বইটা তোমার কেমন লাগল?
পুষ্প চুপ করে রইল।
শওকত সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, বইটা কি তোমার ভাল লাগেনি?
জ্বি না।
ভাল না লাগারতো কথা না। তুমি কি পড়েছু ভাল মত?
জি।
কেন ভাল লাগল না বলতে পারবে?
পারব।
তাহলে বলতো শুনি।
আপনি কি আমার কথায় রাগ করছেন?
না রাগ করছি না। আমার লেখার বিপক্ষে কঠিন কঠিন কথা আমি সব সময় শুনি। সাহিত্যের অধ্যাপকরা বলেন, পণ্ডিত ব্যক্তিরা বলেন, বিদগ্ধ জনের বলেন, তোমার মত অল্প বয়স্ক মেয়ে বলবে তা ঠিক ভাবি নি। বিশেষ করে যে আমার একটি মাত্র বই পড়েছে। এখন তুমি আমাকে বল, কেন ভাল লাগল না।
পুষ্প নীচু গলায় বলল,
বইটার মূল বিষয়টাই ভূল।
মূল বিষয়ই ভূল? কি বলছ তুমি?
ঐটি একটি প্রেমের উপন্যাস। উপন্যাসের মূল বিষয় হল ভালবাসলে ভালবাসা ফেরত দিতে হয়। আপনার বই এর চরিত্ররা তাই করেছে। কিন্তু এমনতো কখনো হয় না। মনে করুন একটা কালো, কুদর্শন মেয়ে প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে একটি রূপবান ছেলেকে ভালবাসল। সেই ছেলে কি তার ভালবাসা ফেরত দেবে? কখনো না। আপনি লিখেছেন মানুষ হচ্ছে আয়নার মত। ভালবাসার আলো সেই আয়নায় পড়লে তা ফিরে আসবে। মানুষ আয়নার মত না। আমার চেয়ে আপনি তা অনেক ভাল করে জানেন। একটা ভুল কথা লিখেছেন–কিন্তু এমন সুন্দর করে লিখেছেন যে পড়লে সত্যি মনে হয়। মন অসম্ভব ভাল হয়ে যায়।
মন ভাল হওয়াটাকে তুমি তুচ্ছ করছ কেন?
ভুল কথা বলে মন ভাল করলে সেটাকে তুচ্ছ করা কি উচিত না?
পুষ্প আমি আরেক কাপ চা খাব।
পুষ্প উঠে গেল। শওকত সাহেব চুপচাপ বসে রইলেন।
পুষ্প চা নিয়ে ফিরে এল।
তিনি বললেন, থ্যাংক ইউ। বলেই হাসলেন। হাসিব অৰ্থ তুমি যা বলেছ শুনলাম। আমি রাগ করিনি। কিন্তু তিনি যে রাগ করেছেন তা ঢাকতে পারছেন