গানের লাইন মনে আছে?
আজ্ঞে প্রথম কয়েকটা চরণ আছে।
বলুনতো দেখি।
ও নদী ততার কানে আমি চুপে বলিলাম।
সোহাগী তোর নামরে নদী, সোহাগী তোর নাম।
এখন সবাই কি নদীটাকে এই নামেই ডাকে?
জি ডাকে। সবাই ডাকে।
শওকত সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন–আসলে সবাই বোধ হয় মনে মনে চাচ্ছিল–এই নদীর সুন্দর একটা নাম হোক। যেই মুহূর্তে নাম পাওয়া গেল–সবাই সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করল।
ভবেশ বাবু বললেন, আর জল ঢালতে হবে না বলে মনে হয়। জ্বর আরো কমেছে। এখন জ্বর হচ্ছে একশ এক। পুষ্প মা, থার্মোমিটারটা দিয়ে দেখতে ঠিক বললাম কি-না।
শওকত সাহেব বললেন, দেখতে হবে না। আপনার কথা বিশ্বাস করলাম।
আজ্ঞে না। পরীক্ষা হয়ে যাক।
পরীক্ষা করা হল। ভ্রর ঠিকই একশ এক।
রুগীকে এখন ঘুমাইতে হবে। পুষ্প মা, রুগীকে একা কইরা দাও। কেউ থাকলেই রুগী কথা বলবো। ঘুম হবে না।
তারা বের হয়ে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শওকত সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙ্গল রাত এগারোটার দিকে। চোখ মেলেই দেখলেন–বিছনার পাশে পুষ্প বসে আছে। একটু দূরে চেয়ারে পা তুলে মোফাজ্জল করিম সাহেব বসে আছেন। তাঁর মুখ ভয়ে পাংশু বৰ্ণ।
মোফাজ্জল করিম সাহেব বললেন, স্যার আপনার শরীর এখন কেমন?
ভাল। শরীর ভাল। আমি আপনাদের দারুণ উদ্বেগে রেখেছি দয়া করে ক্ষমা করবেন।
কিছু খাবেন স্যার? খাওয়ার রুচি হয়েছে?
না। তবে একেবারে খালি পেটে থাকা বোধ হয় ঠিক হবে না। এক গ্লাস দূধ। খেতে পারি।
এশার নামাজ শেষ করে করিম সাহেব খেতে বসলেন।
পুষ্পও বসল তাঁর সঙ্গে। করিম সাহেব বললেন, তোর উপর দিয়ে আজ খুব ঝামেলা গেছে। পুষ্প কিছু বলল না।
ভবেশ বাবুকে বুদ্ধি করে খবর দিয়ে খুব ভাল কাজ করেছিস মী। ভবেশ। বাবু চিকিৎসা কিছু জানেন না। কিন্তু এরা প্রাচীন মানুষ অনেক টোটকা ফোটকা জানেন। সময়মত পানি না ঢাললে অবস্থা হয়ত আরো খারাপ হত। তুইতো কিছু খাচ্ছিস না মা।
আমার খেতে ভাল লাগছে না।
তোর আবার জ্বর আসেনিতো? দেখি বাঁ হাতটা আমার কপালে ছোঁয়াতো।
জ্বর নেই বাবা।
না থাকুক ছোঁয়াতে বলেছি ছোঁয়া।
পুষ্প বাবার কপালে হাত রাখল। করিম সাহেব বললেন, হাততো সোহাগী নদীর পানির মত ঠাণ্ডা।
বলেছিলাম তো, জ্বর নাই।
হুঁ। তাই দেখছি। এদিকে আরেক কাণ্ড হয়েছে উনার আসার খবর দিকে দিকে রটে গিয়েছে। কলমাকান্দার সার্কেল অফিসার চিঠি দিয়ে লোক পাঠালেন–উনাকে নিয়ে তাঁর বাসায় যেন এক কাপ চা খেতে যাই। আমি বলেছি ঠিক আছে।
নিজ থেকে ঠিক আছে বললে কি জন্যে–উনিতে যাবেন না তুমি জানাই।
যেতে পারে। এরা ঘন ঘন মত বদলায়–কাল সকালেই হয়ত বলবেন, করিম সাহেব এক জায়গায় বসে থাকতেতো আর ভাল লাগছে না। চলুন একটু ঘুরা ফেরা করি।
কোনদিনও এই কথা বলবেন না। মাঝখানে তুমি অপমান হবে।
আমাদের স্কুলের সেক্রেটারীর বাসায়ও গিয়েছিলাম–বললাম উনার কথা। মহামূৰ্খ নামও শুনে নাই। যাইহোক বললাম তরফদার সাহেব একটি সম্বৰ্ধনা স্কুলের তরফ থেকেতো দেয়া লাগে। উনি বলেন সম্বর্ধনা দিয়ে কি হবে? মন্ত্ৰী টন্ত্রী হলে সাহায্য পাওয়ার ব্যাপার ছিল। মুখের কথাবার্তা আর কি। যাই হোক শেষকালে রাজি হয়েছেন। তিনশ টাকা সংস্থান করেছেন। একটা হাতে লেখা মানপত্র দেয়া হবে। স্কুলের সব টিচাররা মিলে উনাকে নিয়ে চটা খাবে। এক কাপ চা, সিঙ্গারা, মিষ্টি আর ধর একটা করে কলা।
তোমাদের স্কুলের অর্ধেকটা উড়িয়ে নিয়ে গেছে ঝড়ে আর তোমরা উনার সম্বৰ্ধনায় পয়সা খরচ করবে?
স্কুল উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আবার হবে–উনাকে পাব কোথায়?
খাওয়া শেষ করে করিম সাহেব কুয়াতলায় হাত ধুতে গেলেন। পেছনে পেছনে পুষ্পও এলো চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় আবছা করে সব দেখা যাচ্ছে। পুষ্প থালাবাসন ধুচ্ছে করিম সাহেব একটু দূরে বসে সিগারেট টানতে টানতে মেয়েকে দেখছেন। তাঁর বড় মায়া লাগছে। মেয়েটা কষ্টে পড়ে গেছে। একা কত কি দেখতে হচ্ছে। মতির মাকে কাল যে ভাবেই হোক জোগাড় করতে হবে।
পুষ্প।
জি বাবা।
কয়েকজন গ্রাম্য গাতককে খবর দেয়া দরকার। সন্ধ্যাবেলা একদিন এইখানে একদিন আসর করলে, উনি খুব পছন্দ করবেন।
উনাকে না জিজ্ঞেস করে কিছুই করো না বাবা।
জিজ্ঞেস করেই করব। আমাদের কত বড় সৌভাগ্য চিন্তা করে দেখতে মা–উনার মত মানুষ এই বাড়িতে আছেন। আমাবতত বিশ্বাসই হয় না। ওসি সাহেবকে বলেছি একটা বড় বজরা নৌকা যদি দু এক দিনের জন্যে জোগাড় করতে পারেন।
উনাকে পেলে কোথায়?
স্কুল ঘর ঝড়ে উড়ে গেছে শুনে দেখতে গেছেন। তখন বললাম। ওসি সাহেব উনার বিশেষ ভক্ত, লেখা পড়েছেন।
কুয়াতলা থেকে দোতলার ঘর দেখা যায়। শওকত সাহেবের ঘরের বাতি নেভানো। সেই ঘরের দিকে পিতা এবং কন্যা অনেকক্ষণ আকিয়ে রইল।
শওকত সাহেব বারান্দায় বসেছিলেন
শওকত সাহেব বারান্দায় বসেছিলেন।
আজো তাঁর খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গেছে। ঘুম ভেঙ্গেছে পাখির ডাকে। পাখির দল যে ভোরবেলা এত হৈ চৈ করে তিনি আগে কল্পনাও করেন নি। কবিরা পাখির ডাক নিয়ে এত মাতামাতি কেন করেন তিনি বুঝতে পারছেন না। তাঁর কাছে যন্ত্রণার মত মনে হচ্ছে। তবে রাত কেটে ভোর হবার দৃশ্য অসাধারণ। শুধু মাত্র এই দৃশ্য দেখার জন্যে রোজ ভোরবেলায় ওঠা যেতে পারে।
পুষ্প চা নিয়ে ঢুকল।
শওকত সাহেব বললেন, তুমি কি রোজই এত ভোরে ওঠ, না আমার জন্যে উঠতে হচ্ছে?