রেনু ছুটে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে–চিৎকার করে উঠল–কি হয়েছে? আমার মেয়ের কি হয়েছে?
রেনুর সেই হাহাকার এখনো বুকে বিধে আছে। কবিতার সঙ্গে সঙ্গে সেই হাহাকারও মনে আসে।
ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।
একি যন্ত্রণা! লাইন দুটি আরো গভীরভাবে মাথায় বসে যাচ্ছে। এক সময় মাথা থেকে ছড়িয়ে পড়বে শরীরে। শরীরের রক্ত কণিকাগুলিও তাল মিলিয়ে আবৃত্তি করতে থাকবে।
পুষ্প চা নিয়ে ঢুকেছে।
তিনি পুষ্পের দিকে তাকালেন। পুষ্প চায়ের কাপ টেবিলে রেখে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটি কি এখনো তাকে ভয় পায়? হা নিশ্চয়ই পায়। সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক এখন আর তাঁর কারো সূঙ্গেই নেই। By pains men come to greater pains. বড় হবার জন্যে মানুষকে নানা ধরনের কষ্ট করতে হয়। তারপর দেখা যায় তার জন্যে আরো বড় কষ্ট অপেক্ষা করছে।
পুষ্প তুমি আমাকে একটা কম্বল দিতে পার?
পুষ্প হানা কিছুই বলল না। খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাঁর কপালে হাত রাখল। না–মেয়েটা তাকে খুব বেশী ভয় এখন পায় না। ভয় পেলে এত সহজে কপালে হাত রাখতে পারত না।
পুষ্প।
জ্বি।
কবিতা শুনবে?
পুষ্প চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। কিছুই বলল না।
তিনি নীচু গলায় বললেন–
ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।
পুষ্প কপাল থেকে হাত সরিয়ে, আবার কপালে অন্য হাত রাখল। গা মনে হল পুড়ে যাচ্ছে। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। বাবা এখনো ফিরেনি–ময়নাতলা স্কুলের দপ্তরি ইউনুসকে দিয়ে চিঠি লিখে পাঠিয়েছেন–আমার ফিরিতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হইবে। ঝড়ে স্কুলগৃহের বিপুল ক্ষতি হইয়াছে। হেড মাস্টার সাহেবের অফিসকক্ষের কাগজপত্র বিনষ্ট হইয়াছে। একটা ব্যবস্থা না করিয়া আসিতে পারিতেছি না। এদিকে হেডমাস্টার সাহেব প্ৰাতঃকালে নেত্রকোনা গিয়াছেন, এখনো ফিরেন নাই।
শওকত সাহেব চোখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেললেন। আলো চোখে লাগছে।
পুষ্প।
জি।
কুঞ্জ কে জান?
জি-না।
জীর্ণ দেউল এক, এক কোণে তারি;
অন্ধ নিয়াছে বাসা কুঞ্জ বিহারী।
আমি আপনার জন্যে একটা লেপ নিয়ে আসি।
বাতি নিভিয়ে দিয়ে যাও পুষ্প। বাতি চোখে লাগছে। আমার মনে হয় তুমি আমার কবিতা শুনে ভয় পাচ্ছি। ভাবছ আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে রকম কিছু হয়নি। জ্বর আসার মুহূর্তে কি করে জানি এই কবিতাটা মাথার ভেতর ঢুকে গেছে–কিছুতেই তাড়াতে পারছি না। তোমার এ রকম হয় না?
হয়।
পুষ্প নিচে নেমে এল। ইউনুসকে পাঠাল, ভবেশ বাবুকে খবর দিয়ে আনতে। তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেন। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর কোনরকম খ্যাতি নেই। নিজেই বলেন, ওষুধপত্র যা ছিল সব শেষ। আবার ঢাকায় গিয়ে আনতে হবে। এখন আছে এক প্যাকেট চিনির গুড়া। ভগবানের নাম নিয়ে ঐ দিয়ে দি। ভগবানের অসীম লীলা। এতেই রোগ আরোগ্য হয়।
ভবেশ বাবু তৎক্ষণাৎ এলেন।
রুগীর কপালে হাত দিয়ে বললেন, হোমিওপ্যাথির কম না। জল চিকিৎসা। মা জননী প্রচুর জল দিয়ে শরীর ঠাণ্ডা করা লাগব। জলের ব্যবস্থা করেন। শীতল জল।
শওকত সাহেব টকটকে লাল চোখে তাকালেন। সব কেমন এলো মেলো হয়ে যাচ্ছে। কি একটা জরুরী কথা বলা দরকার। কথাটা মনে পড়ছে না। তবে কবিতার দুচরণ এখন আর মাথায় ঘুর ঘুর করছে না।
ভুবেশ বাবু, মাথায় পানি ঢালতে শুরু করলেন।
ঘুমে শওকত সাহেবের চোখ জড়িয়ে আসছে। এখন আরাম বোধ করছেন। পাশ ফিরে ঘুমুতে ইচ্ছা করছে। পাশ ফেরা যাবে না। পাশ ফিরলে কানে পানি ঢুকবে।
ভবেশ বাবু বললেন, একটু কি আরাম লাগছে স্যার?
লাগছে।
হরে হরে, কৃষ্ণ কৃষ্ণ–জল চিকিৎসার উপর চিকিৎসা নাই। জল হইল আপনার সর্বরোগ গ্ৰাসিনী। জলে যে সব প্রাণী বাস করে তাদের এই কারণে কোন রোগ বালাই হয় না। নিরোগ জীবন যাপন করে।
শওকত সাহেব বললেন, আপনি জানতেন কি ভাবে? এরা অসুস্থ হলেতো আপনাকে খবর দেবে না। ইচ্ছা থাকলেও এদের ক্ষমতা নেই।
স্যার আপনি একেবারেই কথা বলবেন না। চুপ করে থাকেন।
শরীরটা ভাল বোধ হচ্ছে–এই জন্যে কথা বলছি | জ্বর মনে হচ্ছে কমেছে ভবেশ বাবু আপনার কাছে থার্মোমিটার আছে?
আজ্ঞে না। আমি হোমওপ্যাথি করি। থার্মোমিটার এলোপ্যাথ ডাক্তারদের যন্ত্র। আমি নীতিগত ভাবে ব্যবহার করি না।
জ্বর বুঝেন কি ভাবে?
গায়ে হাত দিয়ে বুঝি।
গায়ে হাত দিয়ে আমার জ্বর আপনার কত মনে হয়েছিল?
একশ চারের উপরে ছিল। এখন একশ দূই।
শওকত সাহেব পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার ঐ হ্যান্ড ব্যাগ খুলে দেখ–প্লাষ্টিকের একটা বক্স আছে। ওষুধ পত্র এবং থার্মোমিটার থাকার কথা।
থার্মোমিটার পাওয়া গেল। দেখা গেল জ্বর সত্যি সত্যি একশ দুই। শওকত সাহেব বললেন, ভবেশ বাবু আপনি ভাল চিকিৎসক।
এই কথাটা স্যার আপনি কাগজে লিখে দিয়ে নাম সই করে যাবেন। সার্টিফিকেটের মত সাথে রাখব।
পুষ্প বলল, আরো পানি ঢালবেন চাচা?
ভবেশ বাবু বললেন, অবশ্যই–পানি জ্বর ধুইয়া নিয়ে যাইতেছে। সেই সঙ্গে রোগের যে বিষ ছিল–সেই বিষ।
ভবেশ বাবু।
আজ্ঞে স্যার।
আপনাদের এখানে যে নদী আছে তার নাম কি?
নদীর নাম সোহাগী।
আমিতো জানতাম–ছোটগাঙ।
আগে তাই ছিল–বজলুর রহমান বলে এক পাগল কিসিমের লোক নাম বদলায়ে দিল।
কি ভাবে বদলালো?
মজার ইতিহাস। সভা মিছিল করে একটা হুলুস্থুল করেছেন। রোজ সকালে। উঠে নদীর ধার দিয়ে দৌড়াতেন আর চিৎকার করতেন–সোহাগী, সোহাগী, সোহাগী। স্কুলে ছাত্রদের গিয়ে বলেছেন–তোমরা এই নাম চারদিকে ছড়ায়ে দিবে। তারপর আপনের গান বাঁধলেন সোহাগী নাম দিয়ে।