আমার নাম শওকত।
কোন বাড়ির?
মোফাজ্জল করিম সাহেবের বাড়িতে থাকি।
আপনেতে যাইতেছেন উল্টা পথে। এই পথ গেছে সোহাগী নদীর ঘাটলায়।
কি নদী বললেন?
সোহাগী।
নদীর নাম ছোট গাঙ না?
আমরা মুখের কথায় বলি ছোট গাঙ। ভাল নাম সোহাগী।
শুনে খুশী হলাম। আপনি কি আমাকে মোফাজ্জল করিম সাহেবের বাড়িতে নিয়ে যাবেন? চশমা ভেঙ্গে যাওয়ায় কিছুই দেখছি না।
দেখনের কিছু নাই। আপনে ডাইনের রাস্তা ধইরা নাক বরাবর যান।
শওকত সাহেব নাক বরাবর রওনা হলেন। জোনাকী পোকাগুলি আজ নেই। থাকলে খানিকটা আলো কি আর ওদের কাছ থেকে পাওয়া যেত না? ঝড় সম্ভবত বেচারীদের উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
পুষ্প কখন থেকে হারিকেন হাতে বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে গেছে। এত বড় একটা ঝড় সে খালি বাড়িতে পার করেছে। বিকট শব্দে আতা গাছের একটা ডাল ভেঙ্গেছে। সে ভেবেছিল পুরো বাড়িটাই বুঝি ভেঙ্গে পড়ে গেছে। তার চেয়েও বড় ভয় এই ঝড়ে বিদেশী মানুষটা কোথায় ঘুরছে। কোন বিপদ-আপদ হয়নি তো? বাবাই বা কোথায়? নৌকায় থাকলে নিৰ্ঘাৎ নৌকা ডুবে গেছে।
পুষ্পের গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। তাদের বাড়ি গ্রামের এক প্রান্তে। আশে-পাশে কোন বাড়ি-ঘর নেই যে সে ছুটে গিয়ে বলবে–আমার বড় বিপদ। আমাকে একটু সাহায্য করুন।
শওকত সাহেব নিঃশব্দে উপস্থিত হলেন। পুষ্প হারিকেন উচিয়ে ধরল। তিনি লজ্জিত ও বিব্রত গলায় বললেন, ঝড়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। চশমা টশমা ভেঙ্গে একাকার করেছি।
পুষ্প কিছুই বলল না।
চিনতে পারছ তো আমাকে? কাদা মেখে ভূত হয়ে আছি। তোমাদের বাড়িতে ডেটল জাতীয় কিছু আছে? হাত কেটে ফেলেছি।
পুষ্প হারিকেন উচু করে ধরেই আছে। কিছু বলছে না। মনে হচ্ছে সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে।
তুমি বোধ হয় খুব দুঃশ্চিন্তা করছিলে। এমন ঝড় শুরু হবে কল্পনাও করিনি। তবে মজার ব্যাপার কি জান-–I enjoyed it. শুধু তাই না–I enjoyed it thoroughly. করিম সাহেব কোথায়? উনি ফেরেননি?
না।
তুমি পুরো ঝড়ের সময়টা একা ছিলে?
জি। আপনি কুয়াতলায় আসুন। কাদা ধুয়ে তুলুন। আমি সাবান এনে দিচ্ছি। হাত কতটা কেটেছে?
বেশী না।
দেখি।
তিনি হাত মেলে ধরলেন। অনেকখানিই কেটেছে। রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে।
কূয়াতলা কোন দিকে? আমি এখন প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। হারিকেনটা ভালমত ধর।
পুষ্প বলল, চশমা ছাড়া এখন আপনার চলবে কি করে?
স্যুটকেসে আমার আরেকটা চশমা আছে।
শওকত সাহেব মাথায় প্রায় তিন বালতি পানি ঢেলে ফেললেন। পুষ্প বলল, আর পানি দেবেন না ঠাণ্ডা বাধিয়ে বসবেন।
তিনি হাসিমুখে বললেন, পানিটা গরম, গায়ে ঢালতে খুব আরাম লাগছে। বৃষ্টির পানি কি যে ঠাণ্ডা ছিল কল্পনাও করতে পারবে না। মনে হচ্ছিল শীতে জমে যাচ্ছি। শোন পুষ্প, তোমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না–তুমি খুব কড়া করে এক কাপ চা বানাও।
পুষ্প নড়ল না। সে তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প আবার বলল, আর পানি ঢালবেন না। আপনি নিৰ্ঘাৎ অসুখ বাধাবেন।
আমার কিছু হবে না। আমি হচ্ছি ওয়াটার। যখন ক্লাশ টেনে পড়ি তখন একবার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে পৌষ মাসের শীতে পুকুরের পানিতে সারারাত গলা ডুবিয়ে বসেছিলাম। যদি অসুখ না বাধাই তাহলে একশ টাকা পাব। এই ছিল বাজী। বাজীতে জিতে একশ টাকা পেলাম এবং ওয়াটার গ্রুপ টাইটেল পেলাম। এদিকে আমার বন্ধুরা যারা সারারাত পুকুর পাড়ে বসেছিল তাদের প্রত্যেকের ঠাণ্ডা লেগে গেল। একজনতো নিউমোনিয়ায় মর মর হল।
যে পুষ্প এতক্ষণ গম্ভীর হয়েছিল সে খিল খিল করে হেসে উঠল।
তিনি বললেন, তুমি দেখি হাসতেও পার। আমি ভেবেছিলাম তুমি হাসতে পার না।
পুষ্প বলল, আপনি কি সত্যিই ওয়াটার প্রফ টাইটেল পেয়েছিলেন? সত্যি পেয়েছিলাম। একটা রাবার স্ট্যাম্প বানিয়ে ছিলাম যেখানে লেখা–
Md. Shawkat
W. P.
- P. মানে ওয়াটার প্রুফ। বুঝলে পুষ্প, কেন জানি খুব আনন্দ লাগছে। কারণটা ধরতে পারছি না।
পুষ্প বলল, আমি বলব কারণটা কি?
বল তোত।
ঝড়ের সময় আপনি খুব ভয় পেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন মারা যাচ্ছেন। যখন দেখলেন মারা যাননি এবং ঝড় শেষ হয়েছে তখন আনন্দে মন ভরে গেল।
যুক্তিতে তুমি ভালই দিয়েছ। ভেরি গুড়। আই লাইক ইট। তোমার বুদ্ধি তে ভালই।
আপনি কি ধরেই নিয়েছিলেন বুদ্ধি খারাপ হবে?
খারাপ হবে ধরিনি। এভারেজ বুদ্ধি ধরেছিলাম। ভালও না। খারাপও না।
আপনি কি নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করেন।
হ্যাঁ করি। তুমি কর না?
হ্যাঁ আমিও করি।
ওয়াটার প্রুফ টাইটেল রাখা তাঁর সম্ভব হল না। গোসল শেষ করে গা মুছতে গিয়ে মনে হল জ্বর আসছে। হাত-পা কেমন জানি করছে। মাথা ভারভার হয়ে গেছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্যে নিজের ঘরে ঢুকে সিগারেট ধরালেন। সিগারেট বিস্বাদ লাগল। তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। গায়ে চাদর টেনে দিলেন। চাদরে শীত মানছে না। পুষ্পকে বলতে হবে কল-টম্বল দিয়ে যেতে।
কম্বলের কথা মনে আসতেই–দুলাইনের কবিতাও মনে এসে গেল।
ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।
এখন এই কবিতা মাথার ভেতর ক্ৰমাগত ঘুরপাক খেতে থাকবে। কিছুতেই মাথা থেকে তাড়ানো যাবে না।
ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।
স্বাতীকে এই কবিতা তিনি শুনাতেন। অতি দ্রুত আবৃতি করতেন। স্বাতী কিছু না বুঝেই হাত তালি দিত এবং খিলখিল করে হাসত। হামাগুড়ি দিয়ে তার কাছে এগিয়ে আসত। একবার স্বাতী খাটে বসে আছে–তিনি ঘরে ঢুকে দ্রুত কবিতা পড়লেন। স্বাতী হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসতে গিয়ে খাটি থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।