তিনি প্রথম লাইনটি লিখলেন।
তিনি তাঁর পাণ্ডুলিপি অসংখ্যবার কাটবেন–কিন্তু প্রথম লাইনটি বদলাবেন না।
প্রথম লাইনটি হচ্ছে–পাখি হিসেবে কাক বেশ অদ্ভুত।
লাইনটি তার পছন্দ হচ্ছে না। পছন্দ না হলেও উপায় নেই। এই পাণ্ডুলিপির প্রথম লাইনটি–গ্রহণ করা ছাড়া গতি নেই।
কি লিখবেন সব ঠিক করা আছে। ঘটনা সাজানো আছে। এই লেখায় কি বলতে চান তাও তিনি জানেন। দিনের পর দিন এই লেখাটি নিয়ে তিনি ভেবেছেন। চরিত্রগুলি এখন আর চরিত্র নেই–রক্ত মাংসের জীবন্ত মানুষ। বলতে গেলে গত ছমাসে এই চরিত্রগুলির কারো না কারো সঙ্গে তাঁর রোজই দেখা হয়েছে।
শুরুতে লেখার গতি মন্থর ছিল, কিছুক্ষণের ভেতর গতি বেড়ে গেল। অতি দ্রুত কলম চলতে লাগল। এক বৈঠকে যে করেই হোক পঁচিশ পৃষ্ঠার মত লিখে ফেলতে হবে। চরিত্রগুলিকে বেঁধে ফেলতে হবে। যেন এরা কিছুতেই বেরিয়ে। যেতে না পারে।
বিকেল পাঁচটায় লেখার টেবিল থেকে উঠলেন। বৃষ্টি এখনো নামেনি। আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। তিনি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত বোধ করছেন। দুপুরে কিছু খান নি।
পুষ্প ঠিক দুটার সময় খাবার নিয়ে এসেছিল। তিনি রূঢ় গলায় বলেছেন, আমি লিখতে বসেছি। খবর্দার আমাকে বিরক্ত করবে না।
পুষ্প কঁদো কঁদো গলায় বলল, আপনি দুপুরে খাবেন না?
লেখার টেবিল ছেড়ে উঠলেই খাব। তোমাকে আসতে হবে না। আমি তোমাকে ডেকে আনব। কিন্তু তুমি আর আসবে না। লেখার সময় বিরক্ত করলে
আমি খুব রাগ করি।
পুষ্প আর বিরক্ত করেনি। কিন্তু বেশ কয়েকবার এসে উকি দিয়ে গিয়েছে। একজনকে অভুক্ত রেখে সে নিজেও খাবার নিয়ে বসতে পারে নি।
শওকত সাহেব লেখা কাগজগুলি সুটকেসে ঢুকিয়ে ফেললেন। তিনি এখন হাঁটতে বের হবেন। বৃষ্টির পানি এসে লেখাগুলি আবার নষ্ট না হয়।
এই অবেলায় ভাত খেতে বসার কোন মানে হয় না। রে চার পাঁচটা টিনের কৌটা দিয়ে দিয়েছে। একটায় পনির, দুটা কোটায় বিস্কিট, একটিতে কাজু বাদাম। রাত জেগে লেখার সময় তাঁর ক্ষিধে পায়। ক্ষিধের রসদ। পনিরগুলি টুকরো করে কাটা। দু স্লাইস পনির এবং কয়েকটা কাজু বাদাম মুখে দেয়া মাত্র ক্ষিধে কমে গেল। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। তার মিনিট দশেকের ভেতর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস বইতে লাগল। পুষ্প ছুটে গেল দোতলায়। ঘর তালাবন্ধ। মানুষটা গেল কোথায়? সত্যি সত্যি ঝড় হচ্ছে।
আষাঢ় মাসে এমন ঝড় কি হওয়ার কথা?
কাল বৈশাখী হবে বৈশাখে। আশ্বিন মাসে আশ্বিনা ঝড়। আষাঢ় মাসে প্রবল বৃষ্টিপাত ছাড়াতো কিছু হবার কথা না। শওকত সাহেব খানিকটা দিশাহারা হলেন। ঝড়ের প্রথম ঝাপ্টার সময় তিনি একটা পুকুর পাড়ে। আশে-পাশে কোন জনমানব নেই। খুঁটিতে বাধা একটা গুরু তারস্বরে চিৎকার করছে। পুকুরপাড়ে পাকা কালি মন্দির। সেই মন্দিরের দরজা তালাবন্ধ। উত্তর দিকে ধান ক্ষেত। কি ধান এগুলি? আউস ধান নিশ্চয়। মন্দিরের পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা গিয়েছে নদীর দিকে। ঝড়ের সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা কি ঠিক হবে? মাথার উপর গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়তে পারে। খোলা মাঠে থাকাইতো সবচে ভাল। আউসের ক্ষেতে নেমে পড়বেন?
বৃষ্টি নেমেছে মুষল ধারে। বৃষ্টির পানি কন কনে ঠাণ্ডা। সূচের মত গায়ে বিধছে। তিনি ভিজে পুরোপুরি জবজবে হয়ে গেছেন। চশমার কাচ বৃষ্টির পানিতে অস্পষ্ট হয়ে আছে। এখন চশমা থাকা না থাকার মধ্যে কোন বেশ কম নেই। তিনি চশমা খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছেন। এখন একজন অন্ধের সঙ্গে তাঁর কোন তফাৎ নেই।
ঝড়ের আরেকটা প্রবল ঝাপ্টা এল। বাতাসের কি প্রচণ্ড শক্তি। তাঁকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। হুই হুই হুই…
তিনি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। কেউ কি ডাকছে তাকে? শিষ দেয়ার মত তীক্ষ্ণ শব্দ হচ্ছে বাতাসের। এই শব্দ ছাপিয়ে মানুষের গলা ভেসে আসার কথা না। হুই হুই, ভদ্ৰলোক! হুই।
হ্যাঁ তাকেই ডাকছে। গামছা পরা একজন কে এগিয়ে আসছে। অতি দ্রুত আসছে।
আপনে কোন দেশী বেকুব? ঝড়ের সময় নাইরকেল গাছের নীচে?
তাইতো? তিনি এতক্ষণ কয়েকটা নারিকেল গাছের নীচেই দাড়িয়ে আছেন। তিনি সরে এলেন। বেশীদূর সরতে পারলেন না–বাতাস তাকে ধানক্ষেতে নিয়ে ফেলল। হাতের মুঠিতে ধরা চশমা মট করে ভেঙ্গে গেল। হাত জ্বলা করছে। কেটেছে নিশ্চয়ই। কতটা কেটেছে কে জানে?
নারকেল গাছের নীচ থেকে যে তাকে সরতে বলল, দেখা গেল সেই খুটিতে বাধা গরুটির মালিক। গরু ছেড়ে দিয়ে সেও পলকের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। শওকত সাহেব কাদা পানিতে মাখা হয়ে বৃষ্টি এবং ঝড় কমার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঝড় পুরোপুরি থামার জন্যে তাঁকে আধঘন্টার মত অপেক্ষা করতে হল। এই আধঘন্টায় ময়নাতলা গ্রামের উপর ছোটখাট তাণ্ডব ঘটে গেল। বেশ কিছু কাচা বাড়ি ধ্বসে গেল। কয়েকটা বাড়ির টিনের চাল উড়ে গেল। ময়নাতলা হাই স্কুলের প্রাইমারী সেকশানের কোন চিহ্নই রইল না।
শওকত সাহেব বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। চশমা নেই বলে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। চশমা থাকলেও খুব যে লাভ হত তা না। ঘন অন্ধকার। আকাশ এখনো মেঘে মেঘে ঢাকা। ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। যে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে না বলে অনেক গবেষণা করেছেন–সেই ব্যাঙের ডাক এখন চারদিক থেকেই শোনা যাচ্ছে। সেই ডাকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঝিঝির ডাক।
হারিকেন হাতে কে যেন আসছে। শওকত সাহেব অপেক্ষা করতে লাগলেন। লোকটি কাছে এসে অবাক হয়ে বলল, আপনে কে?