এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই। তুমি বসতো। তোমার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করি। দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস। আরাম করে বস।
পুষ্প তবু দাঁড়িয়েই রইল। সে এখনো চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। তিনি মেয়েটাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। এমন কিছু কি তিনি করেছেন যাতে সে এতটা। ভয় পেয়েছে। তিনি আবারো বললেন–পুষ্প বস।
পুষ্প বসল।
তার বসা দেখে তিনি চমকে উঠলেন। স্বপ্নে পুষ্প ঠিক এই ভাবেই বসেছিল। এমন ভঙ্গিতেই মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল।
মেয়েটার ভয় ভাসিয়ে দেয়া দরকার। মজার কিছু কথা বলে তাকে জানিয়ে দেয়া দরকার যে তিনি ভয়াবহ কোন মানুষ না। এই মেয়ে একবারও হাসে নি। হাসলে তাকে কেমন দেখায়?
পুষ্প।
জি।
গত রাতে তোমাদের বাড়ির বারান্দায় বসে একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলাম। ব্যাপারটা তোমাকে বুলি। গত রাতে বারান্দায় বসে বসে আমি কত বিচিত্ৰ শব্দ শুনলাম কিন্তু ব্যাঙ ডাকতে শুনলাম না। খুবই অবাক হলাম। তারপর ভেবে ভেবে এর একটা কারণও বের করলাম। কারণটা সত্যি কি না তুমি বলতো। দেখি তোমার কেমন বুদ্ধি।
পুষ্প খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে আজ এত সুন্দর লাগছে। কেন? অসহ্য সুন্দর। এক রাতে সে নিশ্চয়ই বদলে যায় নি। তাহলে কি তাঁর দেখার চোখ বদলে গেছে। স্বপ্নটার কারণে এটা হচ্ছে তো?
তিনি পুষ্পের চোখে চোখ রেখে বললেন, কাল পূর্ণিমা ছিল বলে আমার ধারণা। ফকা ফকা জোৎস্না। ব্যাঙ ডাকে ডাঙ্গায় উঠে। চাদের আলোর তাদের দেখা যায়। ব্যাঙগুলি ডাকছিল না, কারণ তারা ভাবছিল ডাকলেই, শব্দ শুনে শেয়ালের পাল এসে উপস্থিত হবে। চাঁদের আলোয় তারা বুঝে ফেলবে কোথায় ব্যাঙরা আছে। শেয়াল এসে এদের কপাকপ খাবে। এই ভয়ে ব্যাঙের দল চুপ করে ছিল। তোমার কি ধারণা আমার যুক্তি ঠিক আছে?
পুষ্প কথা বলল না। তাকিয়ে রইল।
তিনি বললেন, আমার যুক্তি ঠিক নেই?
মনে হয় ঠিক।
মোটেই ঠিক নেই। আমি তোমাকে ভুল যুক্তি দিয়েছি শিয়াল দেখে ব্যাঙ ভয় পাবে কেন? লাফ দিয়ে পানিতে নেমে যাবে।
পুষ্প বলল, তাহলে তারা ডাকছিল না কেন?
আকাশে মেঘ হলে কিংবা মেঘ হবার সম্ভাবনা থাকলেই ব্যাঙ ডাকে। চাদের আলো থাকা মানে–মেঘ নেই। কাজেই ওরা চুপ করে ছিল। বুঝতে পারছ?
জি পারছি।
পুষ্প এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে খুব অবাক হয়েছে।
তিনি বললেন, তোমার বাবা কোথায়?
উনি স্কুলে গেছেন। সন্ধ্যার পর ফিরবেন।
আচ্ছা পুষ্প তোমাদের এই জায়গায় দেখার মত কি আছে?
কিছুই নেই।
একেবারে কিছু নেই তা কি হয়। কিছু নিশ্চয়ই আছে।
নদীর ঐ পাড়ে পুরানো মঠ আছে।
মই কি জিনিস?
আমি নিজেও জানি না–বজলুর রহমান চাচা দেখে এসে বলেছিলেন–এই জিনিস পৃথিবীর অন্য কোন দেশে থাকলে তারা এটাকে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বানিয়ে ফেলত। জিনিসটা বাংলাদেশের মত গরীব দেশে আছে বলে কেউ খবরও রাখে না।
মেয়েটার ভয় সম্ভবত কেটে গেছে সহজ ভাবেই কথা বলছে।
শওকত সাহেব বললেন, বজলুর রহমানের কথার উপর কোন রকম গুরুত্ব দেয়া ঠিক না পুষ্প।
পুষ্প বলল, তা আমি জানি। কিন্তু উনি এত ভাল মানুষ যে কথা শুনলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।
ভালমানুষ কি করে বুঝলে?
পুষ্প জবাব দিল না। কিন্তু তার মুখে এই প্রথম হাসি দেখা গেল। মেয়েটা খুব সুন্দর করে হাসে।
শোন পুষ্প, উনি ভাল মানুষ কি-না তা কিন্তু তুমি জান না। উনার আচার ব্যবহার কাণ্ডকারখানা তোমার পছন্দ হয়েছে–তাই তাকে ভাল মানুষ ভাবছ।
উনি কি ভাল মানুষ না?
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শওকত সাহেব বললেন, যে সব সৎগুণ থাকলে আমরা মানুষকে ভাল মানুষ বলি তা তার নেই। তবে তার চরিত্রে কিছু মজার ব্যাপার আছে। যে কারণে আমিও তাকে পছন্দ করি। তাঁর বিস্মিত এবং মুগ্ধ হবার ক্ষমতা অসাধারণ। এইটিই তাঁর একমাত্র গুণ।
পুষ্প উঠে দাঁড়াল।
আপনার নাশতা নিয়ে আসি।
এক মিনিট দাঁড়াও। আমার ধারণা তুমি মনে মনে বলেছ–আপনার কথাটা ভুল তাই না?
জ্বি–আমি বলেছি।
আচ্ছা যাও নাশতা নিয়ে আস।
পুষ্প থেমে থেমে বলল, আমি কি আপনার সঙ্গে যাব? মঠ দেখানোর জন্যে?
না। কাউকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে আমার ভাল লাগে না।
আপনিতো জানেন না কোথায়।
খুঁজে বের করে নেব। তাছাড়া মঠ দেখতেই হবে এমন কোন কথা নেই। আমি কিছু দেখার জন্যে আসিনি। যাও নাশতা নিয়ে এসো।
নাশতা খেয়ে তিনি খাতা খুলে বসলেন। বেরুতে ইচ্ছা করছে না। জানালার পাশেই টেবিল। দৃষ্টি বাইরে চলে যাচ্ছে। কি সুন্দর আকাশ। আকাশে আবার মেঘ জমতে শুরু করেছে। বর্ষা দেখার জন্যে আসলে গ্রামেই আসা উচিত। জানালার পাশে, বিরাট একটা আতা গাছ। তিনি গাছগাছালি বিশেষ চেনেন না। কিন্তু আতা গাছ চেনেন। ছেলেবেলায় যে বাড়িতে ছিলেন, সে বাড়িতে দুটি আতা গাছ ছিল।
তিনি অনেকক্ষণ আতা গাছের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেবেলার বন্ধুকে যেন অনেকদিন পর দেখলেন। আতা গাছের ডালে কাকের বাসা। সেই বাসায় কাকের ছানা দেখা যাচ্ছে। তাতো হওয়ার কথা না। আষাঢ় মাস ঝড় বৃষ্টির মাস। পাখিদের এই সময় বাচ্চা ফুটানোর কথা না। প্রকৃতি এই ভুল করবে না। তিনি কি চোখে ভূল দেখছেন?
কে বলেছিল কথাটা–কোন লেখকের লেখার টেবিল জানালার পাশে থাকা। উচিত না। জানালার পাশে টেবিল থাকলে তারা কখনো লিখতে পারেন না।
আসলেই বোধ হয় তাই। লেখকের লেখা উচিত চার দেয়ালের ভেতরে আবদ্ধ থেকে। তখনি তারা মনের জানালা খুলে দিতে পারেন।