শেষ পর্যন্ত তারা একটি জায়গা খুঁজে পেল। দোতলায় সবচেয়ে দক্ষিণের একটি ঘর। পুরনো আসবাবে সে-ঘরটি ঠাসা। দুটি জানালাই বন্ধ বলে ঘরের ভেতরটা আর্দ্র ও অন্ধকার! একটি নিষিদ্ধ কিছু করবার উত্তেজনায় সবাই চুপচাপ।
বড়ো রকমের একটি ঝগড়াও শুরু হয়েছে বিয়েবাড়িতে। এসব ঝগড়াগুলি সাধারণত শুরু করেন নিমন্ত্রত গরিব আত্মীয়রা। তাঁরা প্রথমে খুব উৎসাহ নিয়ে বিয়েবাড়িতে আসেন, কোনো একটা কাজ করবার জন্যে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু কিছু করতে না পেরে ক্রমেই বিমর্ষ হয়ে ওঠেন। একসময় দেখা যায় একটি তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তাঁরা মেতে উঠেছেন। চিৎকারে কান পাতা যাচ্ছে না। বরপক্ষীয়দের তরফ থেকে দুটি রুই মাছ পাঠান হয়েছিল, মাছ দুটি নাকি পচা–এই হচ্ছে আজকের ঝগড়ার বিষয়।
তবে সব বিয়েতেই চরম গণ্ডগোলাগুলি যেমন ফস করে নিভে যায়, এখানেও তাই হল। দেখা গেল। বরপক্ষীয় যারা বিয়ের তত্ত্ব নিয়ে এসেছিল (দুটি মেয়ে, একটি অল্পবয়সী ছেলে এবং এক জন মাঝবয়সী ভদ্রলোক), মহানন্দে রঙখেলায় মেতে গেছে। বরের বাড়ির রোগামতো লম্বা মেয়েটিকে দু-তিন জনে জাপটে ধরে সারা গায়ে খুব করে কালো রঙ মাখাচ্ছে! মেয়েটি হাত-পা ছুড়ছে এবং খুব হাসছে।
রঙ ছোঁড়াছুড়ির ব্যাপারটা দেখতে দেখতে ক্ষ্যাপামির মতো শুরু হল। একদল মেয়ে দৌড়াচ্ছে, তাদের পিছু পিছু আরেক দল যাচ্ছে রঙের কৌটো নিয়ে। খিলখিল হাসি, চিৎকার আর ছোটাছুটিতে চারিদিক সরগরম। ছেলেদের দলও বেমালুম জুটে গিয়েছে। অল্পপরিচিত, অপরিচিত মেয়েদের গালে রঙ মাখিয়ে দিতে কিছুমাত্র দ্বিধা করছে না। মেয়েরাও যে এ ব্যাপারে কিছু একটা মনে করছে, তা মনে হচ্ছে না। তাদেরও ভালোই লাগছে।
পরী যখন এসে পৌঁছল, তখন বরের বাড়ির রোগা মেয়েটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।–যাকে দেখাচ্ছে ভূতের মতো। পান্না ভয় পেয়ে বলল, মা, একটা পাগলী, ওমা, একটা পাগলী।
পরীকে দেখতে পেয়ে সবাই ছুটে এল। নিমেষের মধ্যে পরীর ধবধবে গাল আর লালচে ঠোঁট কালো রঙে ড়ুবে গেল। লীনা ও পান্না দু জনেই হতভম্ব। লীনা বলল, এরকম করছে কেন?
হোসেন সাহেব ব্যাপার দেখে সটকে পড়েছেন। সটান চলে গিয়েছেন দোতলায়।
লীনা ও পান্না হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ততক্ষণে রঙ-খেলা চরমে উঠেছে। ভেতরের বাড়ির উঠোনে বালতি বালতি পানি ঢেলে ঘন কাদা করা হয়েছে। মাঝবয়েসী একটি ভদ্রমহিলাকে সবাই মিলে গড়াগড়ি খাওয়াচ্ছে সেই কাদায়। ভদ্রমহিলার শাড়ি জড়িয়ে গেছে, ব্লাউজের বোতাম গিয়েছে খুলে। তিনি ক্রমাগত গাল দিচ্ছেন। কিন্তু সেদিকে কেউ কান দিচ্ছে না। সবাই হাসছে, সবাই চেঁচাচ্ছে। লীনা ও পান্নার বিমর্ষ ভােব কেটে গিয়েছে। তারাও মহানন্দে জুটে পড়েছে সে— খেলায়। পান্না ফূর্তিতে ঘন ঘন চেঁচাচ্ছে। এমন মজার ব্যাপার সে বহু দিন দেখে নি।
জরী এসে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়। সে সবার দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। তার একটু লজ্জা-লজ্জা করছে। পরী কাদামাখা শরীরে জরীকে জড়িয়ে ধরল। জরী বলল, আপা, কখন এসেছিস?
এই তো এখন। তোর কেমন লাগছে জরী?
কী কেমন লাগছে?
বিয়ে।
জরী হাসতে লাগল।
রঙ ছোঁড়াছুঁড়ি
রঙ ছোঁড়াছুঁড়ির হাত থেকে বাঁচবার জন্য হোসনে সাহেব অতিরিক্ত ব্যস্ততায় দোতলায় উঠে এসেছেন। তাঁর গায়ে শার্ক-স্কিনের দামী কোট–নষ্ট হলেই গেল। বিয়েটিয়ের সময় মেয়েদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। উঠোনের কাদায় গড়াগড়ি করাতেও তাদের বাঁধবে না।
দোতলায় তিনি আনিসের ঘরটি খুঁজে পেলেন না। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন শেষ প্রান্তে। সেখানে কিশোরী মেয়েদের দলটি সিগারেট টানছে। তারা হোসেন সাহেবকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। তিনি নিজেও বিস্মিত, তবু হাসি-হাসি মুখে বললেন, আনিসের ঘরটা এক জন দেখিয়ে দাও তো।
কেউ নড়ল না।
আনিসের ব্যথা এখন একেবারেই নেই। শরীর বেশ হালকা ও বারবারে লাগছে। জমাদার এসেছিল ঘর ঝাঁট দিতে, বেডপ্যান সরিয়ে নিতে, তাকে দিয়ে পানি আনিয়ে আনিস দাড়ি কামাল। মুখ ধোওয়া, চুল ব্রাশ করা আগেই হয়েছে। হালকা গোলাপী একটা সিল্কের শার্ট বের করে পরল। বিয়েবাড়ি উপলক্ষে কত লোকজন আসে, এ সময় কি বাসি কাপড়ে ভূত সেজে শুয়ে থাকা যায়? বেশ লাগছে অনিসের। মাঝে মাঝে এরকম চমৎকার সময় আসে। মনে হয় বেঁচে থাকাটা খুব একটা মন্দ ব্যাপার নয়।
খবরের কাগজ দিয়ে গেছে খানিক আগে। আনিস আধশোওয়া হয়ে বসে আছে। খবরের কাগজ কোলে নিয়ে। খবরের কাগজ কোলে নিয়ে বসে থাকাটাও রোমাঞ্চকর ব্যাপার। আনকোরা নতুন কাগজ। এখনো ভাঁজ ভাঙা হয় নি। ইচ্ছা! করলেই পড়া শুরু করা যায়। তবে আনিস। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। তার পড়া শুরু হয় ভেতরের পাতা থেকে। হারান-বিজ্ঞপ্তি, পড়াইতে চাই, রেকর্ডপ্লেয়ার বিক্রি, পাত্রী চাই–এইগুলিই তার কাছে বড়ো খবর। পড়তে আনিসের দরুণ ভালো লাগে। এ থেকেই কত মজার মজার জিনিস চোখে পড়ে। একবার রাইসুদ্দিন নামের এক ভদ্রলোক বিজ্ঞাপন দিল, আকবর ফিরিয়া আসি, যাহা চাও, তাহাই হইবে। তোমার মা রোজ প্যানপ্যান করেন। রোজ প্যানপ্যান করে শব্দটি আনিসের খুব মনে ধরেছিল এবং সে রীতিমত চিন্তিত হয়ে পড়েছিল, আকবর তার মায়ের কাছে ফিরেছে। কিনা তাই ভেবে; আরেক বার আরেকটি বিজ্ঞাপন ছাপা হল।–রোকেয়া সুলতানা নামের এক স্কুল-শিক্ষিকার। বর্ণনার ভঙ্গিটি ছিল এই রকম–আমার বয়স পঁয়ত্রিশ। অবিবাহিতা। নিকট-আত্মীয়স্বজন কেউ বেচে নেই। কোনো সহৃদয় ছেলে আমাকে বিয়ে করলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আমার চেহারা ভালো নয়। শেষ লাইনের আমার চেহারা ভালো নয় বাক্যটি একেবারে বুকে বেঁধে। ভদ্রমহিলাকে একটি চিঠি লিখবার দরুণ ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু কী লিখবে ভেবে পায় নি বলে লেখা হয় নি।