কিন্তু হোসেন যদি আরো একটু কাছে আসত। পরীর কত কী আছে গল্প করবার। সে-সব যদি সে মন দিয়ে শুন্যান্য। কথার মাঝখানে থেমে গিয়ে যদি না বলত।–পরী, আজ বড়ো ঘুম পাচ্ছে, তাহলে জীবনটা অনেক বেশি অর্থবহ ও সুরভিত হত না?
ময়মনসিংহ এসে গেল প্ৰায়। এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি স্টেশনে গাড়ি এ7স থেমেছে। ছাত্রদের দলটি নেমে যাওয়াতে কামরাটি একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। হোসেন সাহেব বই বন্ধ করে জানালা দিয়ে গলা বের করলেন। চমৎকার ইউনিভার্সিটি। সবুজেসুবজে ছয়লোপ। সাদা রঙের বড়ো বড়ো দালানগুলিকে দ্বীপের মতো লাগছে। রাস্তার দুপাশে নারকেল গাছের সারি। পরী বলল, লীনার জ্বর আর নেই। দেখ তো কটা বাজে।
দশটা পনের। আড়াই ঘণ্টা লেট।
পান্না বলল, আড়াই ঘণ্টা লেট হলে কী হয়। বাবা?
খুব মজা হয়। জুতো পরে নাও পান্না, আর দেরি নেই।
লীনাকে শুইয়ে রেখে পরী টয়লেটে গিয়ে চুল আঁচড়াল। পান্নার জুতো পরিয়ে দিল। লীনার ঘুম ভাঙিয়ে, তার জামা বদলে দিল। বেশ লাগছে তার। পরী হালকা গলায় বলল, জরীর গায়ে-হলুদ কি হয়ে গেল?
তোমার জন্যে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করবে।
পরী হাসিমুখে বলল, বউ সাজলে জরীকে কেমন দেখাবে কে জানে?
হোসেন সাহেব জবাব দিলেন না। তিনি খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন।
দুর থেকে স্টেশনের লাল দালান দেখা যাচ্ছে। লাইন বদল হওয়ার ঘটাং ঘটাং শব্দ আসছে। হোসেন সাহেব হঠাৎ বললেন, পরী, আনিসের চিঠির কথাটা মনে আছে? বড়ো কষ্ট লাগছে।
পরী বলল, আনিস বাঁচবে তো?
না। স্পাইনাল কর্ডের লম্বোসেবকরেল রিজিওন ডেমেইজড। তাছাড়া শুধু পেরাপ্লেজিয়া নয়, আরো সব জটিলতা দেখা দিয়েছে। শুনেছি পেথিড়িন দিতে হয়।
পরী গম্ভীর হয়ে পড়ল। হোসেন সাহেব বললেন, কাল রাত থেকে আনিসের চিঠির কথা মনে পড়ছে। তোমার কাছে আছে সেটা।
না নেই।
চিঠিটি আনিস পরীকে অনেক ভণিতা করে লিখেছিল। পাঁচ বৎসরে আনিস মাত্র চারটি চিঠি লিখেছিল। ছয়-সাত লাইনের দায়সারা গোছের চিঠি। কিন্তু শেষ চিঠিটি ছিল সুদীর্ঘ। চিঠিতে অনেক কায়দা-কানুন করে লিখেছে সে জরীকে বিয়ে করতে চায়। কাউকে বলতে লজ্জা পাচ্ছে। তবে জরীর কোনো আপত্তি নেই। এখন একমাত্র ভরসা পরী, পরী যদি দয়া করে কিছু একটা করে তাহলে সারা জীবন সে-ইত্যাদি ইত্যাদি।
পরী এ চিঠি পেয়ে হাসবে কি কাঁদবে ভেবে পায় নি। সে জোর গলায় বলেছে, জরী কিছুতেই রাজি হবে না। ভাইবোনের মতো মানুষ হয়েছি। ছোটবেলায় সবাই এক খাটে ঘুমাতাম।
কিন্তু হোসেন সাহেব খুব শান্ত গলায় বলেছেন, খুব রাজি হবে। আনিসের মতো ছেলে হয় না। তুমি লেখ শ্বশুর সাহেবকে। আমিও লিখব।
আনিসের চিঠি পড়ে হোসেন সাহেবের বুঝতে একটুও অসুবিধে হয় নি যে, চিঠিটা আসলে লিখেছে জরী। আনিস শুধু কপি করেছে। চিঠিতে পাঁচবার আশ্চর্য শব্দটি আছে। ঘন ঘন আশ্চর্য ব্যবহার করা জরীর পুরনো অভ্যাস। তার সব চিঠি শুরু হয়। এইভাবে, আশ্চৰ্য, বহু দিন আপনাদের চিঠি পাই না।
আনিস খুবই ভালো ছেলে এতে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। তবু পরী জানত বাবা রাজি হবেন না। তিনি কোনো একটি বিচিত্র কারণে আনিসকে সহ্য করতে পারতেন না। তাছাড়া আনিসের মা বিধবা হবার পরপরই আরেকটি ছেলেকে বিয়ে করে খুলনা চলে যান। এই নিয়েও অনেক কথা ওঠে। সব জেনেশুনে পরীর বাবা আনিসকে পাত্র হিসেবে পছন্দ করবেন কেন? তাছাড়া এত ঘনিষ্ঠভাবে চেনা একটি ছেলেকে কি বিয়ে করা উচিত? পারী খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল।
এর পরপরই স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হল। পরীকে চিঠি লিখতে আর হল না। সে যখন দেশে ফিরে এল, তখন আনিস কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটালে। সেখান থেকে পি জি-তে।
জরী আনিসকে দেখে খুব কেঁদেছিল। আনিস সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বলেছে, একটা যুদ্ধে অনেক কিছু হয়, জরী। কত বার জরী গিয়েছে হাসপাতালে, কত কথাই তো হয়েছে, কিন্তু ভুলেও আনিস সেই চিঠির উল্লেখ করে নি। জরীও সে-প্রসঙ্গ তোলে নি। যেন তাদের মনেই নেই, তারা দু জনে মিলে চমৎকার একটি চিঠি লিখেছিল পরীকে।
গাড়ি ইন করেছে স্টেশনে। হোসেন সাহেব বললেন, লীনাকে আমার কোলে দিয়ে তুমি নাম পরী।
পরীকে দেখতে পেয়ে একদল ছেলেমেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ইস এত দেরি, এদিকে বোধ হয়। গায়ে-হলুদ হয়ে গেছে।
পরী তাদের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল।
লীনা হাততালি দিল।
বিয়েবাড়ি খুব জমে উঠেছে
বিয়েবাড়ি খুব জমে উঠেছে।
বাড়ির সামনে খোলা মাঠে ছেলেমেয়েরা হৈহৈ করে চি-বুড়ি খেলছে। তাদের চিৎকারে কান পাতা দায়। শিশুদের আরেকটি দল গম্ভীর হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেখানে বাবুচরা রান্না বসিয়েছে, সেখানেও অপেক্ষাকৃত কমবয়সী। শিশুদের জটিল। ছাদে সামিয়ানা খাটান হয়ে গেছে। সেখানে চেয়ার-টেবিল সাজান হয়েছে। অনেকেই ভারিকি চালে চেয়ারে বসে আছে।
কিশোরী মেয়েদের ছ-সাত জনের একটি দল জোট বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিগ্ল উপলক্ষে তারা আজ সবাই শাড়ি পরেছে। সবাই আপ্ৰাণ চেষ্টা করছে যেন তাদেরকে মহিলার মতো দেখায়। এদের মধ্যে শীলা নামের একটি মেয়ে বাড়ি থেকে এক প্যাকেট দামী সিগারেট এনেছে। বিয়েবাড়ির একটি নির্জন আড়াল খুঁজে পেলেই সিগারেট টানা যায়। কিন্তু কোথাও সে-রকম জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। কিশোরীর এই দলটির সবাই কিছু পরিমাণে উত্তেজিত। তারা কথা বলছে। ধীরে ধীরে; মাঝে মাঝেই হেসে উঠছে, তবে সে-হাসির স্বরগ্রামও খুব নিচু।