হোসেন সাহেব টেনে উঠেই একটা বই তাঁর নাকের সামনে ধরে রেখেছেন। গাড়ির ভিড়, লীনার জ্বর বা পান্নার প্রশ্নমালা কিছুই তাঁকে বিচলিত করতে পারছে না। পরীর বিরক্তি ক্রমেই বাড়ছিল। এক সময় সে ঝাঝিয়ে উঠল, রাখি তোমার বই। দেখ মেয়েটার কেমন জ্বর।
হোসেন সাহেব হাত বাড়িয়ে মেয়ের উত্তাপ দেখলেন। শান্ত গলায় বললেন, ও কিছু নয়। এক্ষুণি রেমিশন হবে।
তিনি বইয়ের পাতা ওন্টাতে লাগলেন। পান্না বলল, মা, রেমিশন কী?
কি জানি কী। চুপ করে বসে থাক।
গাড়ির অনেকেই কৌতূহলী হয়ে তাকাচ্ছে পরীর দিকে। পরী সেই ধরনের মহিলা, যাদের দিকে পুরুষেরা সব সময় কৌতূহলী হয়ে তাকায়। চোখে চোখ পড়লেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় না।
রূপবতী মেয়েদের প্রায়ই বড়ো রকমের কোনো ত্রুটি থাকে। পরীর একটিমাত্র ত্রুটি–সে বোকা। হোসেন সাহেব পরীকে বিয়ে করে বেশ হতাশ হয়েছেন। শুধুমাত্র রূপ একটি পুরুষকে দীর্ঘদিন মুগ্ধ করে রাখতে পারে না। পরীর মেয়ে দুটি মায়ের মতো রূপবতী হয় নি দেখে হোসেন সাহেব খুশি হয়েছেন। মেয়ে দুটি বাবার গায়ের শ্যামলা রঙ পেয়েছে। চোখ মুখ নাক ফোলা ফোলা। অনেকখানি মিল আছে চাইনিজ বাচ্চাদের সঙ্গে। এবারভীন হসপিটালের এক নার্স হোসেন সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিল, বাচ্চাদের মা কি চাইনিজ? পরী তার মেয়ে দুটিকে নিয়ে মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তায় ভোগে। বড়ো হলে বিয়ে দিতে ঝামেলা হবে–এই সব ভাবনা তাকে মাঝেমধ্যেই পায়। হোসেন সাহেবকে সে-কথা বলতেই তিনি হো হো করে হাসতে থাকেন। পরী রাগী গলায় বলে, এর মধ্যে হাসির কী হল? কালো মেয়েদের কি ভালো বিয়ে হয়? আমি যদি কালো হতাম তুমি আমাকে বিয়ে করতে? হোসেন সাহেব একটু অপ্রস্তুত হন। মাঝেমধ্যে পরী বেশ গুছিয়ে কথা বলে। হোসেন সাহেব বলেন, আমার সঙ্গে তোমার বিয়েটা তাহলে খুব ভালো বিয়ে করতে চাও?
পরী তার জবাব দেয় না। কারণ মাঝে মাঝে তার নিজেরই সন্দেহ হয়। যদিও হোসেন সাহেব একটি নিখুঁত ভদ্রলোক এবং তাঁকে বিয়ে করবার ফলেই সে পৃথিবীর অনেকগুলি বড়ো বড়ো দেশ ঘুরে বেড়িয়েছে, তবু কোথাও কিছু অমিল আছে। লণ্ডনে থাকাকালীন প্রথম এটি পরীর চোখে পড়ে। পরীকে সারা দিন একা একা থাকতে হত ফ্ল্যাটে। রেকর্ড বাজিয়ে আর রান্না করে কতটুকু সময়ই—বা কাটে! গল্প করার লোক নেই। পরী ইংরেজি জানলেও বলতে পারে না। আবার বিদেশী উচ্চারণ বুঝতেও পারে না। তার সারাটা দিন কাটত কয়েদীর মতো। হোসেন সাহেব ফিরতেন সন্ধ্যাবেলায়। চা খেয়েই তাঁর পড়াশোনা শুরু হত। পরী হয়তো একটা গল্প শুরু করেছে। হোসেন সাহেব হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। কিন্তু কিছু দূর বলবার পরই পরী বুঝতে পারত, হোসেনের গল্প শোনার মুড নেই। সে তাকিয়ে আছে পরীর দিকে ঠিকই, কিন্তু ভাবছে অন্য কিছু। পত্নী আচমকা গল্প বন্ধ করত। হোসেন সাহেব বলতেন, তারপর কী হল?
থাক। আর ভালো লাগছে না।–এই বলে গম্ভীর হয়ে উঠে যেত। পরী। তার আরো খারাপ লাগত, যখন দেখত হোসেন গল্প বন্ধ হওয়ায় খুশিই হয়েছে।
পরী বলল, ময়মনসিংহ আর কত দূর?
হোসেন সাহেব বই থেকে চোখ তুলে বললেন, দূর আছে।
পরী বলল, বাই রোডে এলে কত ভালো হত।
হোসেন সাহেব জবাব দিলেন না। পান্না বলল, বাই রোডে এলে ভালো হত কোন মা?
আর একটা কথা বললে চড় খাবি পানা।
পরী ঝাঁঝিয়ে উঠল। পান্না উশখুশ করতে লাগল। আরেকটা কথা জািনবার জন্যে তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। সে কয়েক বার মার দিকে তাকাল। মা ভীষণ গভীর। কাজেই সে বুকে এল বাবার কাছে। ফিসফিস করে কানে কানে বলল, বাবা, একটা কথা শোন।
বল।
ঐ যে কারেন্টের তারে পাখি বসে আছে দেখেছ?
হুঁ দেখলাম, শালিক পাখি।
ঐ পাখিগুলি শক খায় না কেন?
টেলিগ্রাফের তারে বসে আছে। টেলিগ্রাফের তারে কারেন্ট নেই, তাই শক খায় না।
অ বুঝেছি।
পরী দেখল, মেয়ে ও বাবা খুব আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। সে আগেও দেখেছে, মেয়ের সঙ্গে আলাপে হোসেনের কোনো ক্লান্তি নেই। তখন আর্জেন্ট কলের কথাও মনে থাকে না। জরুরী টেলিফোন করতে হবে বলে হঠাৎ উঠে পড়ারও প্রয়োজন হয় না। পরীর মনে হল সে দারুণ অসুখী ও দুঃখী। এ রকম মনোভাব তার প্রায়ই হয়। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
বিলেতে থাকার সময়ও পরী লক্ষ করেছে তার ব্যাপারে হোসেনের কোনো আগ্রহ নেই। প্রায়ই একগাদা চিঠি আসত পরীর। হোসেন সাহেব ভুলেও জিজ্ঞেস করতেন না চিঠি কে লিখল। সে-সব চিঠির জবাব লিখতে একেক সময় গভীর রাত হয়ে যেত। ঘড়ির কাঁটার নিয়মে ঘুমুতে যেতেন হোসেন সাহেব, ভুলেও জিজ্ঞেস করতেন না এত রাত জেগে কোথায় চিঠি লেখা হচ্ছে।
হোসেনের এক বন্ধু প্রায়ই আসত বাসায়। সে পরীর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করত। পরী কোনো কোনো দিন ইচ্ছে করেই সেই বন্ধটির সঙ্গে বেড়াতে যেত। ফিরতে রাত হত প্রায় সময়ই। পরী চাইত, হোসেনের মনে একটু সন্দেহ দেখা দিক। ঈর্ষার কিছু জীবাণু কিলবিল করে উঠুক। তাঁর মনে। কিন্তু সে-রকম কিছুই হয় নি। হোসেন নির্বিকার ও নিরাসক্ত। হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিল পরী। লীনা-পান্না এল সংসারে। যমজ মেয়ে এক সামলান মুশকিল। রাত জাগা, কাপড় বদলে দেওয়া, ঘড়ি দেখে দেখে দুধ বানান-এ সব করতে করতে এক সময় পরীর মনে হল সংসারটা এমন কিছু খারাপ জায়গা নয়। হোসেনের মতো স্বামী নিয়ে সুখী হতে বাধা নেই।