আনিস ক্ষেপে গিয়ে বলল, যাও এখানে থেকে–যাও।
ছেলেটি প্যান্ট ছেড়ে দিয়ে হাত দিয়ে চোখের জল মুছল। অনেক দূর নেমে গেল প্যান্ট। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমি হারিয়ে গেছি। আম্মাকে খুঁজে পাই না।
কী নাম তোমার?
বাবু।
আনিস খাণিকক্ষণ তাকিয়ে রইল বাবুর দিকে। হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে কোমল সুরে বলল, ভেতরে এস বাবু।
বাবু সংকুচিত ভঙ্গিতে ভেতরে এসে ঢুকল। একটু ইতস্তত করে বলল, তুমি কাঁদছ কেন?
আমার অসুখ করেছে।
পেটে ব্যথা?
হুঁ।
বস তুমি চেয়ারে। তোমার আম্মাকে খুঁজে দেব! তুমি কোথায় থাক?
বাসায় থাকি।
কী নাম তোমার?
বলেছি তো এক বার।
ও, তোমার নাম বাবু। বস একটু।
আনিস তোয়ালে দিয়ে আবার কপালের ঘাম মুছল। নটা বেজে গেছে। রোদ এসেছে ঘরের ভেতরে। একটা ভ্যাপসা ধরনের গরম পড়েছে। বাসি-বিছানা থেকে এক ধরনের ভেজা গন্ধ আসছে। বাবু বসে আছে চুপচাপ, সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আনিসের দিকে।
আনিস ভাই, ভিতরে আসব?
দরজার ওপাশে জরীর বন্ধুরা কৌতূহলী চোখে উঁকি দিচ্ছে। এদের মধ্যে এক রুনুকেই আনিস চিনতে পারল।
আনিস বলল, জরী আসে নি?
না। সে একতলায় আটকা পড়েছে।
জরীর গায়ে-হলুদের আয়োজন চলছে নিচে। পরীর জন্যে অপেক্ষা করতে করতেই গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠান পিছিয়ে গেল। পরীর আসবার সময় হয়েছে। তাকে আনতে স্টেশনে গাড়ি গিয়েছে।
গায়েহলুদ
চিত্ৰিত পিঁড়িতে বসে আছে জারী। কলসীতে করে পানি এনে রাখা হয়েছে। জরীর সামনে ডালায় বিচিত্র সব জিনিসপত্র সাজান। সেখানে আবার দুটি প্রদীপ জ্বলছে। রাজ্যের মেয়েরা ভিড় করেছে সেখানে। বরের বাড়ি থেকে পাঠান গায়েহলুদের শাড়ি নিয়ে বেশ হৈচৈ হচ্ছে। কাজের বেটিরাও নাকি এত কমদামী শাড়ি পরে না–এ ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে। রুনু এই ফাঁকে তার বন্ধুদের দোতলায় নিয়ে এসেছে। কনক তখন থেকেই আনিসের সঙ্গে দেখা করবার কথা বলছিল।
আনিস বলল, ভেতরে আস রুনু। কী ব্যাপার?
আনিস ভাই, এরা সবাই জরী। আপার বন্ধু, তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছে।
আনিস বিরক্তি চেপে কোনো মতে বলল, তোমরা বস।
ঘরে বসবার কিছু নেই। একটিমাত্র চেয়ার, সেটিতে বাবু গম্ভীর হয়ে বসে আছে আনিস কী বলবে ভেবে পেল না। বিরতভাবে বলল, হঠাৎ আমার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে হল কেন?
কেউ সে কথার জবাব দিল না। রুনু কনককে দেখিয়ে বলল, এর নাম কনক, খুব নামকরা মেয়ে আনিস ভাই। রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। সে-ই আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে বেশি ব্যস্ত।
কনক চুপ করে রইল। আভা বলল, আপনি আমাদের যুদ্ধের গল্প বলুন, আনিস ভাই।
আনিস থেমে থেমে বলল, আমি যুদ্ধের কোনো গল্প জানি না।
কেন, আপনি আমির সঙ্গে যুদ্ধ করেন নি?
করেছি।
সেই গল্প বলুন।
আমি যুদ্ধের গল্প বলি না।
আভা মুখ কালো করে ফেলল। লায়লা বলল, চল, কনক। যাই, গায়েহলুদের সময় হয়ে গেছে। কনক নড়ল না। থেমে থেমে বলল, যুদ্ধের সময় আমি বড়ো কষ্ট করেছি আনিস ভাই। বরিশালের কাছে এক জঙ্গলে আমি, আমার মা আর দুই খালা এক সপ্তাহ লুকিয়ে ছিলাম। এক খালা সেই জঙ্গলেই ভয় পেয়ে মারা গিয়েছিলেন।
আনিস বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল কনকের দিকে। কনক গাঢ় স্বরে বলল, খুব কষ্ট করেছি বলেই যারা যুদ্ধ করেছে তাদের আমার সব সময় খুব আপন মনে হয়।
কনকের কথার মাঝখানে আনিস হঠাৎ বলে উঠল, আমি খুব অসুস্থ। তোমার সঙ্গে পরে আলাপ করব। রুনু, এই ছেলেটিকে নিয়ে যা। সে তার মাকে খুঁজে পাচ্ছে না।
বাবুকে রুনু কোলে তুলে নিতে গেল। বাবু চেয়ারে আরও ভালো করে সেটে বসল। আনিসের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, আমি যাব না। আমি এখানে থাকব।
রুনু তাকে দু হাত ধরে উপরে তুলতেই সে পা ছুঁড়ে কাঁদতে শুরু করল। রুনু বলল, আনিস ভাই, আমরা যাই?
আচ্ছা যাও। কিছু মনে করো না কনক।
না-না আনিস ভাই, আমি কিছু মনে করি নি।
আনিস হাঁপাতে শুরু করল। অসহ্য! খুব ঘাম হচ্ছে। বুক শুকিয়ে কাঠ। দাঁতে দাঁত চেপে সে মনে মনে গুনল–এক শ, নিরানব্বুই। দরজায় টোকা পড়ল। আনিস তাকাল ঘোলা চোখে। বাবু আবার ফিরে এসেছে। আনিস চোখ বন্ধ করে ফেলল। বাবু বলল, আমি এসেছি।
আনিস কোনো মতে বলল, বাবু, এক গ্লাস পানি আন।
আনিসের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। পেথিট্ৰিন দিতে হবে নাকি কে জানে! বড়োচাচাকে খবর দেওয়া প্রয়োজন।
বাবু পানির খোঁজে বেরিয়ে একা একা ঘুরে বেড়াতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল ছাদে। সেখানে মিস্তিরিরা সামিয়ানা খাটাচ্ছে। সে অনেকক্ষণ তাই দেখল। তারপর নেমে এল দোতলায়। দোতলা খা-খাঁ করছে। সবাই গিয়েছে গায়ে-হলুদে। সে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
জরীর বড়োচাচা তার রেডিওগ্রাম বন্ধ করে দিয়ে বিরক্ত হয়ে বারান্দায় বসে ছিলেন। বাবু তাকে গিয়ে বলল, পানি খাব। তিনি তাকে পানি খাইয়ে দিলেন। বাবু শান্ত হয়ে আনিসের ঘর খুঁজে বেড়াতে লাগল।
পরীর ট্রেন
পরীর ট্রেন ভোর সাড়ে আটটার মধ্যে ময়মনসিংহ পৌঁছোনর কথা। কিন্তু গফরগাঁ আসতেই পৌনে নটা হয়ে গেল। মেল টেন, অথচ ছোট-বড়ো সব স্টেশন ধরছে। লোক উঠেছে বিস্তর। ছাদে পর্যন্ত গাদাগাদি ভিড়। ফার্স্ট ক্লাস কামর্যাগুলি অপেক্ষাকৃত ফাঁকা ছিল। কিন্তু কাওরাইব্দে এক দঙ্গল ছাত্র উঠে পড়ল। বিপদের ওপর বিপদ। পরীর মেয়ে লীনা কদিন ধরেই সর্দিতে ভুগছিল। টেনে ওঠার পর থেকে তার জ্বর হুঁ-হু করে বাড়তে লাগল। পরী মেয়েকে কোলে করে জানালার এক পাশে বসেছে, তার অন্য পাশে বসেছে পান্না। পান্না এক দণ্ডও কথা না বলে থাকতে পারে না। সে ক্রমাগত মাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে : এটা কী মা? ঐ লোকগুলি নৌকায় কী করছে মা? ঐ নৌকাটার পাল লাল, আর এইটার সাদা কেন মা?