না, সতের তারিখে যাবে।
একাই যাচ্ছে?
না। বড়োচাচা সঙ্গে যাবেন।
কনক বলল, কী জন্যে যাচ্ছেন? কই, আমি তো কিছু জানি না?
জরী অস্বস্তি বোধ করল। থেমে থেমে বলল, চিকিৎসা করাতে যাচ্ছে। মেরুদণ্ডে গুলী লেগেছিল। সেই থেকে পেরাপ্লেজিয়া হয়েছে। কোমরের নিচে থেকে অবশ্য।
আমাকে তো কিছু বলিস নি তুই, গুলী লাগল কী করে?
আমির লেফটেন্যান্ট ছিলেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে যখন পাক-আর্মির সাথে যুদ্ধ হয়, তখন গুলী লেগেছে।
লায়লা বলল, জরীর এই ভাইটিকে তো তুই চিনিস, কনক মনে নেই–এক বার আমরা সবাই দল বেঁধে আনন্দমোহন কলেজে থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলাম? তখন যে একটি ছেলে সন্ন্যাসী সেজেছিল, হঠাৎ নাটকের মাঝখানে তার দাড়ি খুলে পড়ে গেল। ঐ তো আনিস। যা মুখচোরা ছিল।
জয়ী একটু হেসে বলল, ছোটবেলায় আনিস ভাই ভীষণ বোকা ছিল। একেক বার এমন হাসির কাও করত! তাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেলেই হয়েছে, হয়। সেখানে একটা কাপ ভাঙবে, নয় চেয়ার নিয়ে হঠাৎ গড়িয়ে পড়বে।
রুনু বলল, বাঘের গল্পটা বল জয়ী, ওটা ভীষণ মজার।
না থাক।
বল না, শুনি।
এক বার আমরা সবাই জঙ্গল বয় ছবি দেখে এসেছি। আনিস ভাই ফিরে এসেই বড়চাচার সোয়েটার গায়ে দিয়ে বাঘ সেজেছে। আর আমরা সেজেছি হরিণ। আনিস ভাই হালুম শব্দ করে আমার ঘাড় কামড়ে ধরল। কিছুতেই ছাড়বে না। রক্তটক্ত বেরিয়ে সারা, শেষে বড়োচাচা এসে ছাড়িয়ে দিলেন। দেখ, এখনো দাগ আছে।
জরীর মা দোতলা থেকে ডাকলেন, ও মেয়েরা, চা দেওয়া হয়েছে, এস। শিগগির। সবাই দেখল, তাঁর মুখ খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। একজন সুখী চেহারার মা, যার খোঁপায় গোঁজা ফুলটি এখনো রয়েছে। হয়তো ফেলে দিতে তাঁর মনে নেই, কিংবা ইচ্ছা করেই ফেলেন নি।
আভা বলল, চা খেয়ে আমরা আনিস ভাইয়ের সঙ্গে একটু গল্প করব, কেমন জরী?
বেশ তো, কারবি।
যুদ্ধের গল্প শুনতে আমার খুব ভালো লাগে!
কনক বলল, কই, আর সানাইয়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না তো?
সানাই বাজছিল ঠিকই, কিন্তু বিয়েবাড়ির হৈচৈ এত বেড়েছে যে শোনা যাচ্ছে না!
তারা সবাই দোতলায় উঠে এল। সিঁড়িতে জরীর বাবার সঙ্গে দেখা। তিনি দ্রুত নামছিলেন। জরীকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় বললেন, শুনেছিস কারবার, রশীদ টেলিফোন করেছে।–দৈ নাকি পাওয়া যাবে না। জরী, তুই আমার সোয়েটারটা বের করে দে, আমি নিজেই যাই। তাড়াতাড়ি কর। এমন গাধার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন–বলে তাঁর খেয়াল হলে বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, আমি নিজেই খুঁজে নেব। জরীর বন্ধুরা হাসতে লাগল।
শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে
সমস্ত শরীর মনে হচ্ছিল অবশ হয়ে যাচ্ছে। কোমরে কাছে চিনচিনে ব্যথা ক্রমশ তীব্র ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। সে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছল। ব্যাথাটা শুরু হলেই ভীষণ ঘাম হয় ও পানির প্রবল তৃষ্ণা হয়। আজ টেবিলে পানির জগটি শূন্য। বিয়েবাড়ির ব্যস্ততার জন্যেই হয়তো রাত্রিতে পানি রেখে যেতে কারো মনে নেই। আনিস উন্টোদিকে এক শ থেকে গুনতে শুরু করল। এক শ, নিরানব্বুই, আটানব্বুই-। কোনো একটা ব্যাপারে নিজেকে ব্যস্ত রাখা, যাতে ব্যথাটা ভুলে থাকা যায়।
ঘড়িতে সাড়ে ছটা বাজে। অন্য দিন এই সময়ে টিংকু এসে পড়ে। আজ আসে নি। বিয়েবাড়ির হৈচৈ ফেলে সে যে আসবে, এরকম মনে হয় না। তবু দরজার পাশে কোনো একটা শব্দ হতেই আনিস উৎকৰ্ণ হয়ে ওঠে। না, টিংকু নয়। আবার স্লোয়ালে দিয়ে মুখের ঘাম মুছে আনিস কাৎরাতে থাকে। আশি, উনআশি, আটাত্তর, সাতাত্তির,। সাতটা বেজে গেছে। আজ তাহলে টিংকু আর এলই না।
অন্য দিন ভোর ছটার মধ্যে দরজায় ছোট ছোট হাতের থাবা পড়ত। চিনচিনে গলা শোনা যেত, আনিস, আনিস।
কী টিংকুমনি?
আমি এসেছি, দরজা খোল।
আনিসের খাটটি এমনভাবে রাখা, যেন সে শুয়ে শুয়েই দরজার হুঁক নাগাল পায়। টিংকুর সাড়া পেলেই সে দরজা খুলে দিত। দেখা যেত ঘুম-ঘুম ফোলা মুখে চার বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথাভর্তি লাল চুল। গায়ে কোনো ফ্রক নেই বলে শীতে কাঁপছে। দরজা খুলতেই সে গম্ভীর হয়ে বলবে, আনিস, তোমার ব্যথা কমেছে?
হ্যাঁ টিংকু।
আচ্ছা।
তারপর সেই লাল চুলের মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পড়বে বিছানায়। তার হৈচৈ-এর কোনো সীমা থাকবে না। একসময় বলবে, আমি হাতি-হাতি খেলব। তখন কালো কম্বলটা তার গায়ে জড়িয়ে দিতে হবে। একটি কোলবালিশ ধরতে হবে তার নাকের সামনে এবং সে ঘনঘন হুঁঙ্কার দিতে থাকবে। আনিস বারবার বলবে, আমি ভয় পাচ্ছি, আমি ভয় পাচ্ছি। এক সময় ক্লান্ত হয়ে কম্বল ফেলে বেরিয়ে আসবে সে। হাসিমুখে বলবে, আনিস, এখন সিগারেট খাও। টিংকু নতুন দেয়াশলাই জ্বালাতে শিখেছে, সে সিগারেট ধরিয়ে দেবে। কিন্ত আজ দিনটি শুরু হয়েছে অন্যরকম ভাবে।
আজ টিংকু আসে নি। আনিস আবার ঘড়ি দেখল। সাড়ে সাতটা বাজে। অন্য দিন এ সময়ের মধ্যে তার দাড়ি কামান হয়ে যেত। বাসি জামা-কাপড় বদলে ফেলত। ভোরের প্রথম কাপ চা খাওয়াও শেষ হত। আজ হয় নি। রাত থাকতেই যে অসহ্য ব্যথা শুরু হয়েছে দিনের আলোর সঙ্গে সঙ্গে তা যেন ক্রমেই বাড়ছে। পিপাসায় বুক-মুখ শুকিয়ে কাঠ।
খুট করে শব্দ হল দরজায়। আনিস চমকে উঠে বলল, কে, টিংকু নাকি? টিংকু? কিন্তু টিংকু আসে নি, একটি অপরিচিত ছেলে উঁকি দিচ্ছে। আনিস কড়া গলায় ধমক দিল, গেট এওয়ে, গেট এওয়ে।
ভয়ে ছেলেটির চোখে জল এসে গেল। তার পরনে স্ট্রাইপ-দেওয়া লাল ব্লেজারের শার্ট ও মাপে বড়ো একটি সাদা প্যান্ট। প্যান্ট বারবার খুলে পড়ছে, আর সে টেনে টেনে তুলছে।