ইনিয়ে বিনিয়ে ভৈরবীর সুরে সানাই বাজছে। যে-সুরটি ওঠানামা করছে সেটি যেন একটি শোকাহত রমণীর বিলাপ। অন্য যে-সুরটি ক্রমাগত বেজে যাচ্ছে সেটি যেন বলছে–কেন্দো না মেয়ে, শোন, তোমাকে কী চমৎকার গান শোনাচ্ছি।
জরীর বন্ধুদের ঘুম ভেঙেছে। জারী ঘরে নেই। লায়লা গাঢ় স্বরে ডাকল, ও কনক, কনক।
কি?
সানাই শুনছিস?
শুনছি।
ভালো লাগছে তোর?
না। খুব মন খারাপ করা সুর।
তারা সবাই ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। আভা গলা উঁচিয়ে ডাকলে, জরী, জরী : জর ছাদ থেকে আসতেই সবাই দেখল, তার চোখ ঈষৎ রক্তাভ ও ফোলা ফোলা। রুনু বলল, রাতে তোর ঘুম হয় নি, না রে?
খুব হয়েছে।
এখন তোর কেমন লাগছে। জারী?
কেমন আর লাগবে। ভালোই। আয়, বাগানে বেড়াতে যাই।
তারা বাগানে নেমে গেল। এ-বাড়ির বাগানটি পুরনো। জরীর দাদার খুব ফুলের শখ ছিল। মালী রেখে চমৎকার বাগান করেছিলেন। বসরাই গোলাপের প্রকাণ্ড একটি ঝাড় ছাড়া এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বাড়ির সর্ব-দক্ষিণে বেশ কিছু হানুহেনাগাছ আছে। সেখানে হাঁটু উঁচু বড়ো বড়ো ঘাস গজিয়েছে। ওদিকটায় কেউ যায় না।
আভা বলল, এত সুন্দর বাগান, কেউ যত্ন করে না কেন রে?
জরী বলল, বাগানের শখ নেই কারো। এক পরী আপার ছিল, সে তো আর থাকে না এখানে।
লায়লা বলল, পরী। আপা কি আগের মতো সুন্দর আছে?
এলেই দেখবি।
কখন আসবেন?
সকাল সাড়ে আটটায়, ময়মনসিংহ এক্সপ্রেসে।
কনক বলল, এত বড়ো গোলাপ হয় নাকি, আশ্চর্য জরী, গোলাপ তুলব একটা?
তোল না।
চার জন অলস ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সবাই কিছু পরিমাণে গভীর। লায়লা ঘনঘন কাশছে। কাল রাতে তার ঠাণ্ডা লেগেছে। কনকের দেখাদেখি সবাই গোলাপ ছিঁড়ে খোঁপায় গুজেছে। আভা। হঠাৎ করে বলল, তোদের এখানে বকুলগাছ নেই, না?
উঁহু।
আমার হঠাৎ বকুলফুলের কথা মনে পড়ছে। আমাদের স্কুলের বকুলগাছটার কথা মনে আছে তোদের?
সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। স্কুলের বকুলগাছটা নিয়ে অনেক মজার মজার ব্যাপার আছে।–
জরীর মা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়েদের দেখছিলেন। তিনি সেখান থেকে চেঁচিয়ে ডাকলেন, ও জরী, জারী।
কী মা?
কী করছিস তোরা?
কনক বলল, বেড়াচ্ছি–আপনিও আসুন না খালাম্মা।
জরীর মা হাসিমুখে নেমে এলেন। মনে হল মেয়েদের দলে এসে তাঁর বয়স যেন হঠাৎ করে কমে গিয়েছে। তিনি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, গত রাতে একটা মজার স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, জরী যেন খুব ছোট হয়ে গিয়েছে। ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাগানে। আর জেগে দেখি সত্যি তাই।
বললেই হল। আমি বুঝি ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি?
জরীর মা হাসতে লাগলেন। হালকা গলায় বললেন, আমার যখন বিয়ে হয়, তখন এ বাগানটা আরো বড়ো ছিল। আমি রোজ সকালে এখানে এসে একটা করে ফুল খোপায় গুজতাম।
বলেই তিনি হঠাৎ লজ্জা পেয়ে গেলেন। লায়লা বলল, আসুন খালা, আজ আপনার খোঁপায় ফুল দিয়ে দি।
কী যে বল মা, ছিঃ ছিঃ!
কিন্তু ততক্ষণে কনক একটি ফুল ছিঁড়ে এনেছে। জরীর মা আপত্তি করবার আগেই তারা সেটি খোঁপায় পরিয়ে দিল। তিনি বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, আমি তোমাদের চায়ের যোগাড় করি। আর দেখ, হাস্নুহেনা-ঝাড়ের দিকে যেয়ো না। খুব সাপের আড্ডা ঐদিকে।
শীতকালে সাপ কোথায় খালা?
না থাক, তবুও যাবে না।
জরীর মা চলে যেতেই আভা বলল, খালা এখনো যা সুন্দর, দেখলে হিংসা লাগে।
পরী আপাও ভীষণ সুন্দর। তাই না জরী?
হ্যাঁ। আর আমি কেমন?
পরী আপা ফার্স্ট ক্লাস হলে তুই ইন্টার ক্লাস, আর আমাদের কনক হচ্ছে এয়ারকণ্ডিশণ্ড ফার্স্ট ক্লাস।
কনক একটু গম্ভীর হয়ে পড়ল। জরীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোর খুব মায়াবী চেহারা জরুরী। রূপবতী হওয়া খুব বাজে ব্যাপার।
বাজে হলেও আমি রূপবতী হতে রাজি।
সবাই হেসে উঠলেও কনক হাসল না। অসাধারণ সুন্দরী হয়ে জন্মানীয় সে অনেক বার বাথরুমে দরজা বন্ধ করে কেঁদেছে। অনেক বার তার মনে হয়েছে, সাধারণ একটি বাঙালী মেয়ে হয়ে সে যদি জন্মাত! শ্যামলা রঙ, একটু বোকারোকা ধৰ্মনের মায়াবী চেহারা। কিন্তু তা হয় নি। পুরুষের লুব্ধ দৃষ্টির নিচে অনেক যন্ত্রণার মধ্যে তাকে বড়ো হতে হয়েছে। অথচ ছোটবেলায় কেউ যখন বলত, কনকের মতো সুন্দর একটি মেয়ে দেখেছি আজ। তখন কী ভালোই না লাগত।
কুয়াশা কেটে রোদ উঠেছে। ধানী রঙের নরম রোদ। শিশিরভেজা মাটি থেকে আএ এক ধরনের গন্ধ আসছে। মেয়েদের দলটি গোল হয়ে বসে আছে শিউলিগাছের নিচে। এই গাছটি এক সময়ে প্রচুর ফুল ফোটাত। আজ তার আর সে-ক্ষমতা নেই। কয়েকটি সাদা সাদা ফুল পড়ে আছে। শীতের বাগানে যখন ধানী রঙের রোদ ওঠে এবং সেখানে যদি কয়েকটি মেয়ে চুপচাপ গোল হয়ে বসে থাকে, তাহলে বাগানের চেহারাই পাল্টে যায়। বড়োচাচা অবাক হয়ে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বিয়েবাড়ির লোকজন
বিয়েবাড়ির লোকজন ক্রমে ক্রমে জেগে উঠছে। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের হুঁটোপুটি আর কানার শব্দ শোনা যাচ্ছে। টিউবওয়েলে ঘটাং ঘটাং ব-রে ক্রমাগত পানি তোলা হচ্ছে। ডেকোরেটরের দোকান থেকে লোকজন এসে গেটের জন্য মাপজোক শুরু করেছে। জরীর বাবা অকারণে একতলা থেকে দোতলায় ওঠানামা করছেন। মাঝে মাঝে তাঁর উঁচু গলা শোনা যাচ্ছে, এক ঘণ্টা ধরে বলছি এক কাপ চা দিতে। শুধু এক কাপ চা, এতেই এত দেরি? মেয়ের বিয়ে কি আর কাৰো হয় না?
আভা, হঠাৎ বলল, জরী, তোর ছোটচাচার ছেলে কি আমেরিকা চলে গেছে?