তিনি জরীর দিকে তাকিয়ে সস্নেহে হাসলেন। জরী বলল, একটা হালকা সুবাস পাচ্ছেন বড়োচাচা?
পাচ্ছি।
বলুন তো কিসের?
তিনি ভাবতে চেষ্টা করলেন। শিউলি ফুলের নাকি? বাগানে একটি শিউলিগাছ আছে। কিন্তু সে-ফুলের গন্ধ তো হালকা।
এতক্ষণে সূর্য উঠল। গাছে গাছে কাক ডাকছে। কিচির-মিচির করতে করতে দুটি শালিক এস বসল ছাদে। জরী হাত বাড়িয়ে দুটি আমের পাতা ছিঁড়ে এনে গন্ধ শুকল। তিনি দেখলেন জরী কাঁদছে। তিনি চুপ করে রইলেন। আহা একটু কাঁদুক। এমন একটি সময়ে না। কাঁদলে মানায় না। তাঁর ভীষণ ভালো লাগল। তিনি কোমল গলায় বললেন, জরী, দেখ সূৰ্য উঠেছে। এমন সুন্দর সূর্যোদয় কখনো দেখেছিস?
জরী চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, সন্তাহার যাবার সময় এক বার টেনে দেখেছিলাম।
দেখ, আজকে আবার দেখ।
জরী ফিসফিস করে বলল, কী সুন্দর।
বলতে বলতে জরী আবার চোখ মুছল। তিনি নরম গলায় বললেন, বোকা মেয়ে, আজকের দিনে কেউ কাঁদে? ঐ দেখ দুটি শালিক পাখি। দুই শালিক দেখলে কী হয় মা?
জরী ফিসফিস করে বলল, ওয়ান ফর সরো, টু ফর জয়।
ঠিক তখনি জরীর বন্ধুরা নিচ থেকে জরী জরী করে চেঁচাতে লাগল। জারী নিঃশব্দে নিচে নেমে গেল।
তিনি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। ভোরের এরকম অচেনা আলোয় মন বড়ো দুর্বল হয়ে যায়। আপনাকে ক্ষুদ ও অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। বড়ো বেশি মনে পড়ে, দিন ফুরিয়ে গেল। তিনি সুর করে পড়লেন–ফবিআয়ে আলা। রাব্বিকুমা তুকাজ জি বান।
চার বান্ধবী
কাল রাতে চার বান্ধবী জরীকে নিয়ে একখাটে ঘুমিয়েছিল। এরা অনেক দিন পর একসঙ্গে হয়েছে। লায়লার সঙ্গে জরীর দেখা হয়েছে প্ৰায় চার বছর পর। আভা ও কনক ময়মনসিংহ থাকলেও দেখাসাক্ষাৎ প্রায় হয় না বললেই চলে। রুনু জরীর দূরসম্পর্কের বোন। স্কুলের পড়া শেষ হবার পর একমাত্র তার সঙ্গেই জরীর রোজ রোজ দেখা হত। পুরনো বন্ধুদের মধ্যে শেলী ও ইয়াসমীন আসে নি।
অনেক দিন পর মেয়ে বন্ধুরা একত্রিত হলে একটা দারুণ ব্যাপার হয়। আচমকা সবার বয়স কমে যায়। প্রতিনিয়ত মনে হয় বেঁচে থাকাটা কী দারুণ সুখের ব্যাপার!
জরীর বন্ধুরা গত পরশু থেকে ক্লান্তিহীন হৈচৈ করে যাচ্ছে। গুজগুজ করে খানিকক্ষণ গল্প, পরমুহুর্তেই উচ্ছ্বসিত হাসি। আবার খানিকক্ষণ গল্প, আবার হাসি। এক জনকে হয়তো দেখা গেল। হঠাৎ কী কারণে দল ছেড়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। তার পিছনে পিছনে ছুটছে বাকি সবাই। খিলখিল হাসির শব্দে সচকিত হয়ে উঠছে। বাড়ির লোকজন।
গতরাতটা তাদের জেগেই কেটেছে। আভা তার প্রেমের গল্প বলেছে। রাত একটা পর্যন্ত। তার প্রেমিকটি এক জন অধ্যাপক। আভার বর্ণনানুসারে দারুণ স্মার্ট ও খানিকটা বোকা। সে তার স্মার্ট প্রেমিকটির দুটি চিঠিও নিয়ে এসেছিল বন্ধুদের দেখাতে। কাড়াকড়ি করে দেখতে গিয়ে সে চিঠির একটি ছিঁড়ে কুটিকুটি। অন্যটি থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবাই বানান ভুল বের করতে লাগল। এক-একটি ভুল বের হয়, আর আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সবাই।
মাঝরাতে লায়লার হঠাৎ চা খাবার ইচ্ছে হল। কনক বলল, চমৎকার, চল সবাই–ছাদে বসে চা খাই।
রুনুরাজি হল না। তার নাকি ঘুম পাচ্ছে। সে বলল, এই শীতে ছাদে কেন? এখানেই তো বেশ গল্পগুজব করছিস।
কনক বলল, ছাদে আমি গান শোনাব। সঙ্গে সঙ্গে দলটি চেঁচিয়ে উঠল। গত দু দিন ধরেই কনককে গাইবার জন্যে সাধাসাধি করা হচ্ছে। লাভ হয় নি। কনক কিছুতেই গাইবে না। লায়লা এক বার বলেই ফেলল, একটু নাম হয়েছে, এতেই এত তেল? টাকা না পেলে আজকাল তুই আর গাস না?
কনক কিছু বলে নি, শুধু হেসেছে।
ধুপধাপ শব্দ করে সবাই যখন ছাদে উঠল, তখন নিশীথ রাত। চারদিকে ভীষণ অন্ধকার। জরী বলল, দুর ছাই, জোছনা নেই। আমি ভেবেছিলাম জোছনা আছে।
আভা বলল, আমার ভয় করছে ভাই, গাছের ওপর ওটা কি?
ওটা হচ্ছে তোর অধ্যাপক প্রেমিকের এঞ্জেল বডি। তোকে দেখতে এসেছে।
সবাই হো হো করে হেসে উঠল। এই হাসির মধ্যেই গান শুরু করল কনক, সঘন গহন রাত্রি–
গান শুরু হতেই সবাই চুপ করে গেল। আভা চাপা গলায় বলল, কী সুন্দর গায়। বড়ো হিংসা লাগে।
কনকের গলা খুব ভালো। ছোটবেলায় কিন্তু কেউ বুঝতে পারে নি, অল্প সময়ে কনকের এত নাম-ডাক হয়ে যাবে। রেডিওতে প্রথম যখন গায় তখন সে কলেজে পড়ে। তার পরপরই তার গানের প্রথম ডিস্ক বের হয়–যার এক পিঠে আমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই অন্য পিঠে ওগো শেফালী বনের মনের কমিশন।
কনক পরপর চারটি গান গাইল। গানের মাঝখানে জরীর মা চায়ের পট নিয়ে মৃদু অনুযোগের সুরে বললেন, নাও তোমাদের চা! এত রাত্রে ছাদে গান-বাজনা কি ভালো? চা খেয়ে ঘুমুতে যাও সবাই।
কেউ নড়ল না। রুনু বলল, কনক, আজ সারা রাত তোমাকে গাইতে হবে।
জরীর মা-ও এক পাশে বসে পড়লেন। জরীর বড়োচাচাও উঠে এলেন ছাদে। আসর যখন ভাঙল তখন রাত দুটো। জরীর বড়োচাচা বললেন, বড়ো ভালো লাগল মা, বড়ো মিঠা গলা। জরীর গলাও ভালো ছিল। কিন্তু সে তো আর শিখল না।
আভা বলল, এখন শিখবে।
সবাই খিলখিল করে হেসে উঠল। কনক বলল, আপনার একটা গান শুনি?
অন্য দিন, আজ অনেক রাত হয়েছে। তোমরা ঘুমুতে যাও।
সে-রাতে করোরই ভালো ঘুম হল না। জরীর বড্ড মন কেমন করতে লাগল। তার ইচ্ছে করল মার কাছে গিয়ে ঘুমোয়। কিন্ত সে মড়ার মতো পড়ে রইল। আভা একবার ডাকল, জরী, ঘুমিয়েছিস? জারী তার জবাব দিল না। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। শুধু জরী জেগে রইল। বিয়ের আগের রাতে কোনো মেয়ে কি আর ঘুমুতে পারে?