খুব ছোটবেলায় আনিসের যখন এগার-বার বৎসর বয়স, তখনই বড়োচাচা আনিসের তীব্র অতিমানের খোঁজ পান। বড়ো হয়েছে বলে আনিস তখন আলাদা ঘরে ঘুমায়। তার ঘরটি একতলায়। পাশের ঘরে আনিস, জরী ও পরীদের মাস্টার সাহেব থাকেন। এক রাত্ৰিতে খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। বড়োচাচা আনিসের ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় শুনলেন আনিস কাঁদছে। তিনি ডাকলেন, আনিস, কী হয়েছে রে?
আনিস ফুঁপিয়ে বলল, ভয় পাচ্ছি।
আয় আমার ঘরে। আমার সঙ্গে থাকবি?
না।
তাহলে আমি সঙ্গে শুই?
দরজা খোল তুই।
আনিস দরজা খুলল না। তিনি অনেকক্ষণ বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। বড়োচাচার মনে হল জরীর বিয়ের এই দিনটি আনিসের জন্যে খুব একটা দুঃখের দিন। কিন্তু তাঁর কিছুই করবার নেই।
যে-ছেলেটির সঙ্গে জরীর বিয়ে হচ্ছে, তার খোঁজ বড়োচাচাই এনেছিলেন। তাঁর আবাল্যের বন্ধু আশরাফ আহমেদের বড়ো ছেলে। নাম ও বিনয়ী। লাজুক ও হৃদয়বান; দেখতে আনিসের মতো সুপুরুষ নয়। রোগা ও কালো। জরীর বাবা আপত্তি করেছিলেন। বারবার বলেছেন, ছেলের ধরনধারণ যেন কেমন। জরীর মারও ঠিক মত নেই; মিনমিন করে বলেছেন, ইউনিভার্সিটির মাস্টার, কয় পয়সা আর বেতন পায়। কিন্তু বড়োচাচার প্রবল মতের বিরুদ্ধে কোনো আপত্তিই টিকল না। তাঁর যুক্তি হচ্ছে জরীর মতো একটি ভালো মেয়ের জন্যে এ-রকম এক জন ভাবুক ছেলেই দরকার, যে গল্প-কবিতা লেখে—জরী সুখ পাবে। কিন্তু আপত্তি উঠল সম্পূৰ্ণ ভিন্ন জায়গা থেকে। বড়োচাচা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
তিনি সেদিন শয্যাশায়ী। দাঁতের ব্যথায় কাতর। সন্ধ্যাবেলা ঘরের বাতি জ্বলেন নি। অন্ধকারে শুয়ে আছেন। জয়ী এসে কোমল গলায় ডাকল, বড়োচাচা।
কি জরী?
আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি।
বড়োচাচা বিছানায় উঠে বসলেন!। বিস্মিত হয়ে বললেন, বাতি জ্বালা, জরী।
না, বাতি জ্বালাতে হবে না।
জরী এসে বসল। তাঁর পাশে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, কী হয়েছে, জরী?
বড়োচাচা, আমি—
বল, কী ব্যাপার!
জরী থেমে থেমে বলল, বড়োচাচা, আমি ঐ ছেলেটিকে বিয়ে করব না।
কেন, কী হয়েছে?
বড়োচাচা, আমি আনিস ভাইকে বিয়ে করতে চাই।
জরী কাঁদতে লাগল। বড়োচাচা স্তম্ভিত হয়ে বললেন, আনিস জানে?
জরী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, জানে। তাকে আসতে বলেছিলাম, তার নাকি লজ্জা লাগে।
দু জনেই বেশ কিছু সময় চুপচাপ কাটাল। বড়োচাচা এক সময় বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে।
সে-রাতে তিনি একটুও ঘুমুতে পারলেন না। অনেক বার তাঁর ইচ্ছে হল তিনি আনিসের কাছে যান, কিন্তু তিনি নিজের ঘরেই বসে রইলেন। তাঁর অনেক পুরনো কথা মনে পড়তে লাগল।
জরীর অনেক অদ্ভুত আচরণ অর্থবহ হল। একটি মেয়ে তো শুধু শুধু একা ছাদে বসে কাঁদতে পারে না। সে চোখের জলের কোনো-না–কোনো কোমল কারণ থাকে। আশ্চর্য! এ সব তার চোখ এড়িয়ে গেল কী করে?
বিয়ে বড়োচাচাই ভেঙে দিয়েছিলেন। যদিও কাউকেই বলেন নি, এত আগ্রহ যে-বিয়ের জন্য ছিল। হঠাৎ তা উবে গেল কেন।
আজ জরীর বিয়ে হচ্ছে। এবং আশ্চৰ্য, সেই ছেলেটির সঙ্গেই। মাঝখানে একটি ভালোবাসার সবুজ পর্দা দুলছে ঠিকই, কিন্তু তাতে কী? জীবন বহতা নদী। একটি মৃত্যুপথযাত্রী যুবকের জন্যে তার গতি কখনো থেমে যায় না। থেমে যাওয়া উচিত নয়।
বড়োচাচার কষ্ট হতে লাগল। জরীর জন্য কষ্ট। আনিসের জন্য কষ্ট! এবং সেই সঙ্গে তাঁর মৃতা স্ত্রীর জন্যে কষ্ট। তাঁর ইচ্ছে হল আবার আনিসের ঘরে যান। তার মাথায় হাত রেখে মৃদু গলায় বলেন, আনিস তোর মনে আছে, এক বার আমার সঙ্গে জন্মাষ্টমীর মেলায় গিয়েছিলি, সেখানে–
তিনি আবার আনিসের ঘরে ফিরে এলেন।
আনিস পা দোলাতে দোলাতে সিগারেট টানছিল। বড়োচাচাকে দেখে সে সিগারেট লুকিয়ে ফেলল।
কিছু বলবেন চাচা?
না-না, কিছু বলব না। বড়োচাচা আবার ফিরে গেলেন।
দুপুরের রোদ
দুপুরের রোদ সরে গেছে।
শীতের বিকেল বড্ড দ্রুত এসে যায়। বেলা তিনটে মোটে বাজে, এর মধ্যেই গাছের ছায়া হয়েছে দীর্ঘ, রোদ গিয়েছে নিভে। বৈকালিক চায়ের যোগাড়ে ব্যস্ত রয়েছেন জরীর মা। হাতে সময় খুব অল্প, সন্ধ্যা সাতটার আগেই বরযাত্রী এসে যাবে। তারা খবর পাঠিয়েছে, নটার মধ্যেই যেন সব শেষ করে কনে বিদায় দিয়ে দেওয়া হয়।
রান্নাবান্না হয়ে গিয়েছে। ছাদে টেবিল-চেয়ার সাজোনও শেষ। এক শ বরযাত্রীকে এক বৈঠকেই খাইয়ে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। বাড়ির সামনে ডেকোরেটররা চমৎকার গোট বানিয়েছে। সন্ধ্যার পরপরই ইলেকট্রিক বাল্বের আলোয় সেই গেট ঝলমল করবে।
জরীর বাবার অফিস সুপারিনটেনডেন্ট কি মনে করে যেন দুপুরবেলাতে এসে পড়েছেন। জরীর বাবা সারাক্ষণ তীর সঙ্গেই আছেন। জরীর মার হাতে যদিও কোনো কাজ নেই। তবু তিনি মুহূর্তের জন্যেও ফুরসত পাচ্ছেন না। আজ তাঁর গোসলও কর হয় নি, দুপুরের খাওয়াও হয় নি। সারাক্ষণই ব্যস্ত হয়ে ঘুরঘুর করছেন।
এখন তাঁর প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। তবু এই মাথাধরা নিয়েই বিরাট এক কেৎলি চা বানিয়ে নিয়ে এসেছেন।
পাড়ার মেয়ে এবং জরীর বন্ধুরা জরীকে ঘিরে বসেছিল। চা আসতেই অকারণ একটা ব্যস্ততা শুরু হল। কনক বলল, জীরী, তুই চা খাবি এক কাপ?
না, আমার শরীর খারাপ লাগছে।
খা না এক ঢোক।
চায়ে প্রচুর চিনি ও এলাচ দেয়ায় পায়েসের মতো গন্ধ। তবু চমৎকার লাগছে। খেতে জরীর মা বললেন, চপ আনতে বলেছি। যে কয়টা পার খেয়ে নাও সবাই–রাতে খেতে দেরি হবে। আবার একটা হুল্লোড় উঠল।
কন্যাপক্ষীয় মেহমান
কন্যাপক্ষীয় মেহমানদের আসবার বিরাম নেই। রিকশা এসে থামছে। হাসিমুখে নামছে চেনা লোকজন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিশে যাচ্ছে বিয়েবাড়ির স্রোতে। এরকম একটা উৎসবে কাউকেই আলাদা করে চেনা যায় না। সবাই বাড়ির লোক হয়ে যায়। আনিসের মা তাই রিকশা থেকে নেমে হকচকিয়ে গেলেন।