আমরা নানাভাবে তাকে যন্ত্রণা করি। যেমন তিনি রেজিস্ট্রার খাতা হাতে যখন ক্লাসে ঢুকেন তখন আমরা সব কয়টি মেয়ে একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলিআসসালামু আলায়কুম। আমাদের এই সমবেত চিৎকারে কলেজ কেঁপে উঠে। তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অসহায় ভঙ্গিতে বলেনওয়ালাইকুম সালাম। তাঁকে ভয়ঙ্কর সব পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হয়। যেমন একদিন ক্লাসের পড়া শেষ করে বললেন, কারো কোন প্রশ্ন আছে। আমাদের ক্লাসের সবচে স্মার্ট মেয়ে মবকুলা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জ্বি স্যার আছে।
বল।
আপনি এমন অদ্ভুত পোশাক পরে ক্লাসে আসেন কেন?
অদ্ভুত পোশাকতো না। আমাদের নবীজী এই পোশাক পরতেন।
নবীজীতো উটে চড়ে ঘোরাফেরা করতেন। আপনি উটে না চড়ে রিকশায় আসেন কেন?
উটের প্রচলন। এখানেই নেই। থাকলে হয়ত আসতাম।
হো হো করে আমরা হেসে উঠলাম। স্যার চোখ মুখ লাল করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে করুণ গলায় বললেন, আচ্ছা যাই আসসালামু আলায়কুম।
আমরা সমস্বরে হুংকার দিয়ে উঠলাম— ওয়ালাইকুম সালাম। আমাদের হুংকারে কলেজ বিল্ডিং কেঁপে উঠল।
একদিন বিকেলে ছাদে হাঁটছি, মা এসে বলল, বাইরে এক ভদ্রলোক এসেছেন। তোর বাবা চা চাচ্ছে। চা দিয়ে আয়। আমি দুকাপ চা নিয়ে ঢুকে অবাক হয়ে দেখি— আমাদের চেংড়া হুজুর। আজ তাঁর পোশাক আরো চমৎকার। মাথায় পাগড়ি পরেছেন। বিয়ের আসরে ছেলেরা পাগড়ি পরে বলে জানি কিন্তু কেউ যে পাগড়ি পরে অন্যের বাড়িতে বেড়াতে আসতে পারে তা জানা ছিল না। ভদ্রলোক কি উন্মাদ? তিনি আমাকে দেখে মাথা নিচু করে ফেললেন। বাবা বললেন, নবনী উনি মহিলা কলেজের একজন শিক্ষক। আমাদের যে বাড়তি দুটা ঘর আছে। ঐ ঘর দুটা তিনি ভাড়া নেবেন।
আমি বললাম, বাবা আমি উনাকে চিনি। উনি আমাদের ইতিহাস পড়ান।
ইতিহাস পড়ান? বলিস কি। আমিতো ভেবেছি এরাবিকের টিচার।
স্যার মেঝের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনারেল হিস্ট্রীতে এম. এ. করেছি।
বাবা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ও আচ্ছা। তাহলে তো ভালই হল। গুড। ভেরী গুড। একসেলেন্ট।
আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, কেমন আছেন স্যার? তিনি ঠিক আগের মতই মাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ভাল। তুমি ভাল আছ নবনী?
স্যার যে আমার নাম জানেন তা জানতাম না। আমি চমকে উঠলাম।
চা নিন স্যার। চুমুক দিয়ে দেখুন চিনি হয়েছে কি-না।
স্যার আমার দিকে তাকালেন। কি আশ্চর্য এত সুন্দর চোখ! কি শান্ত! কি মায়াকাড়া! না-কি এসব আমার কল্পনা। স্যার চোখ নামিয়ে নিয়েছেন। আমার বলতে ইচ্ছা করছে, আপনি আমার দিকে তাকিয়ে চা খানতো স্যার। মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? মেঝেতে কি আছে দেখার?
টিয়া পাখির ট্যাঁ ট্যাঁ শোনা যাচ্ছে।
ভোর হয়ে গেছে। বৃষ্টি এখনো থামে নি। আমি দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি আমাদের বিদায়ের আয়োজন চলছে। ভোর বেলা ট্রেন। এক্ষুণি রওনা না হলে ট্রেন ধরা যাবে না। বড় মামা সবাইকে তাড়া দিচ্ছেন।
আমার সমস্যার গল্প আজ আর বলা হল না।
ঢাকার বাসা
আমি ঢাকায় ওর বাসায় উঠে এলাম।
সেগুন বাগিচায় অফিসের সাথেই বাসা। একতলা দোতলা জুড়ে অফিস। দোতলার পেছন দিকে ওর বাসা। একটা মোটে ঘর। বারান্দার খানিকটা অংশ আলাদা করে রান্নাঘর। গ্যাসের ব্যবস্থা নেই। কেরোসিনের চুলায় রান্না। বারান্দায় অন্য মাথায় বাথরুম। বাথরুম এবং রান্নাঘরের মাঝের ফাঁকা জায়গাটার আট-দশটা ফুলের টব। সপ্তম আশ্চর্যের মত সেখানে একটা পাখির খাঁচায় ময়না পাখি।
ও খুব আগ্রহ করে বলল, বুঝলে নবনী! এই ময়না মানুষের চেয়ে সুন্দর করে কথা বলে। দুদিন যাক, দেখবে তোমার গলা হুবহু নকল করবে। ও নকলে খুব ওস্তাদ।
ময়না বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাকে দেখছে। কোন কথা বলছে না। আমি বললাম, কই, কথা বলছে না তো?
হঠাৎ তোমাকে দেখেছে— এই জন্যে। কয়েকদিন যাক, তারপর দেখবে ওর কথার যন্ত্রণায় থাকতে পারবে না। আমার বাড়ি-ঘর তোমার পছন্দ হয় নি, তাই না নবনী?
হয়েছে।
পছন্দ যে হয় নি সেটা তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। একা মানুষ তো, বিরাট বাড়ি নিয়ে কি করব? তাছাড়া বাড়িটা কিন্তু ভাল। খুব হাওয়া। ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি আছে। ছাদে যাওয়া যায়। ছাদে যাবে? আচ্ছা, পরে তোমাকে নিয়ে যাব। টায়ার্ড হয়ে এসেছ, এখন রেষ্ট নাও। আমি চা নিয়ে আসি।
ও ঘর থেকে ফ্লাস্ক নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে নেমে গেল। এই বাসার সব কিছুই ছোট ছোট। সে যে ফ্লাস্কটা নিয়ে বের হয়েছে সেটিও ছোট। এক কাপ চা ধরবে কি-না কে জানে। আমি ঘুরে-ফিরে তার সংসার দেখতে লাগলাম।
শোবার ঘরে একটা খাট। সেই খাটে একটাই বালিশ। আমার জন্যে দ্বিতীয় বালিশ কেনে নি। হয়ত আজি সন্ধ্যাবেলা বালিশ কিনতে যাবে। কিংবা কে জানে হয়তো একটা বালিশেই দুজনকে ভাগাভাগি করে ঘুমুতে হবে। একটা লেখার টেবিল খাটের সঙ্গে লাগানো। টেবিলের সঙ্গে চেয়ার নিই। কাজই ধরে নেয়া যায় লেখালেখির কাজ খাটে বসে। সারা হয়। টেবিলের পাশে মিটাসেফের মত আছে। সেখানে নতুন একটা টি-সেট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই টি-সেট এখনো ব্যবহার করা হয় নি। কাপড় রাখার আলনা আছে। আলনায় কাপড় নেই। কয়েকটা তোয়ালে এবং গামছা–ভাজ করে রাখা। কে জানে হয়ত তোয়ালে রাখার জন্যেই এই আলনা।
দেয়ালে কিছু বাঁধানো ছবি আছে। একটি তার বাবার ছবি। চেহারার মিল থেকে বলে দেয়া যায়। তার পাশের ছবিটি বোধহয় তার মার। এই মহিলা খুব রূপবতী ছিলেন।