ও হাসল। ছোটখালা আমাদের চা খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে রইলেন। যাবার সময় বাতি নিভিয়ে গেলেন। ও উঠে গিয়ে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ছিটিকিনি লাগল। খাটের দিকে আসতে গিয়ে চেয়ারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আমি উঠে এসে তাকে ধরলাম। ও লাজুক গলায় বলল, মোটেও ব্যথা পাই নি। তোমাকে ধরতে হবে না।
আমি হাত ধরে তাকে খাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। মনে মনে ভাবছি–ইরার উপন্যাসের সেই নায়ক শুভ্ৰকেও কি তার স্ত্রী ধরে ধরে খাটের দিকে নিয়ে যেত?
নবনী!
উঁ।
তুমি খুব বেশি সুন্দর। আরেকটু কম সুন্দর হলে ভাল হত।
কম সুন্দর হলে ভাল হত কেন?
এম্নি বললাম, কথার কথা। সফিক তার স্ত্রীকে সবসময় এই কথা বলে।
উনার স্ত্রী কি খুব সুন্দর?
হ্যাঁ খুব সুন্দর। কালো কিন্তু সুন্দর। তার নামটাও অদ্ভুত। অহনা। আর কোন মেয়ের এমন নাম শুনেছ?
না।
নবনী!
কি?
আমি এর আগে কখনও কোন মেয়ের হাত ধরি নি। এই যে তোমার হাত ধরেছি। কেমন যেন ভয়-ভয় লাগছে। এই দেখ, আমার শরীর কাঁপছে।
ওর কথা শুনে আমার কি যে ভাল লাগল! চোখে পানি এসে গেল। বাসররাতে সব মেয়েই বোধহয় কোন-না-কোন উপলক্ষে চোখের পানি ফেলে। আমি ফেললাম। আমার সেই চোখের পানিতে আনন্দ ছিল, সুখ ছিল। সেই সুখ ও আনন্দের তেমন কোন কারণ ছিল না। অকারণ সুখ অকারণ আনন্দও তো মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে আসে।
রাত এখন কত আমি জানি না। আমার হাতে ঘড়ি নেই। একটা ঘড়ি ছিল। ইরার বান্ধবীরা ঘড়ি খুলে নিয়েছে। বাসর ঘরে না-কি ঘড়ি নিয়ে ঢুকতে নেই। ঘড়ি নিয়ে ঢুকলেই কিছুক্ষণ পরপর ঘড়ি দেখতে ইচ্ছে করবে। বাসর রাতটা হবে এমন যেখানে সময় বলে কিছু থাকবে না। আমি ইরার বান্ধবীদের সঙ্গে কোন তর্ক করি নি। ওরা ঘড়ি খুলতে চেয়েছে। আমি খুলে দিয়েছি। ওরা যদি ভাবে ঘড়ি খুলে রাখলেই সময় বন্ধ হয়ে যাবে-ভাবুক।
ও বিছানার একপাশে গুটিশুটি মেরে ঘুমুচ্ছে। খাটের একেবারে শেষপ্রান্তে চলে গেছে। আমার কেবলই ভয় হচ্ছে এই বুঝি গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। ইচ্ছে করছে তাকে নিজের কাছে টেনে নেই। ইচ্ছে করলেও সম্ভব না। মানুষের সব ইচ্ছা পূর্ণ হবার নয়। তবে আমি বেতের চেয়ারটি খাটের পাশে এনে রেখেছি। গড়িয়ে পড়লেও মেঝেতে পারবে না। চেয়ারের উপর পারবে।
বৃষ্টি কিছু সময়ের জন্যে থেমেছিল। এখন আবার প্রবল বেগে শুরু হয়েছে। বাতাসও দিচ্ছে। শো শো শব্দ হচ্ছে। এ বাড়ির কেউই বোধহয় ঘুমায়নি। বারান্দায় তাদের হাঁটাহাটির শব্দ পাচ্ছি। হাসাহাসির শব্দও হচ্ছে। সবচে বেশি। হাসছে ইরা। খিলখিল খিলখিল। হাসছেতো হাসছেই। ইরা বোধহয় আজ হাসির বিশ্ব রেকর্ড করল। কি নিয়ে তাদের এত হাসাহাসি? কাদাখেলা কি শেষ হয় নি? না-কি আজ সারারাতাই চলবে?
আমার ঘুম আসছে না। আমি ভোর হবার জন্যে অপেক্ষা করছি। ভোরবেলা একা একা ছাদে খানিকক্ষণ হাটব। ও যদি জেগে থাকে–ওকেও সঙ্গে নেব। আমার ধারণা এই পৃথিবীতে অল্প যে কয়টি সুন্দর জায়গা আছে আমাদের বাসার ছাদটা তার একটা। উঁচু রেলিং দিয়ে ছাদটা ঘেরা। শ্যাওলা জমে রেলিং হয়েছে গাঢ় সবুজ। মনে হয় ইট পাথরের রেলিং নয়–সবুজ লতার রেলিং। বাড়ির পেছনের প্রকাণ্ড শিরীষ গাছটা বেঁকে এসে ছাতার মত ছায়া ফেলেছে ছাদের উপর। গাছ ভর্তি টিয়া পাখি। সকাল এবং সন্ধ্যায় বাক বেঁধে টিয়া পাখি উড়তে থাকে। তীক্ষ্ণ গলায় ডাকে ট্যা ট্যা। টিয়া পাখিগুলো খুব অদ্ভুত এরা মানুষের দেয়া খাবার কখনো খায় না। আমি কতবার ছাদে চাল ছড়িয়ে দিয়েছি–কাক এসে খেয়ে গেছে। টিয়ারা কাছে আসে নি।
ভোরবেলা যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে আমি ইরাকে বলব আমাদের দুজনকে ছাদে চা দিতে। ইরা মনে মনে হাসবে। পরে হয়ত ঠাট্টাও করবে। করুক ঠাট্টা। এমন একটা সুন্দর জিনিস ওকে না দেখিয়ে নিয়ে যাব তা হয় না। তাছাড়া আমি ঠিক করেছি–চা খেতে খেতে ভোরের প্রথম আলোয় ওকে বলব–আমার জীবনের ভয়াবহ সমস্যার কথা। ওকে সমস্যাটা বলে রাখা দরকার। সব শোনার পর সে যদি বলে—নবনী! তুমি এইখানেই থাক। তোমাকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব না। তাহলে এখানেই থেকে যাব। বিশাল এই বৃক্ষের ছায়ায় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে আমার খুব খারাপ লাগবে না। সেই মানসিক প্ৰস্তুতি আমার আছে।
ওকে আমি কি ভাবে কথাটা বলব? শুরু করাটাই সমস্যা। একবার শুরু করলে বাকিটা আমি তরতার করে বলে যেতে পারব। শুরু করব কি ভাবে? এই ভাবে কি শুরু করা যায়?
এই শোন, আমার এক সময় একজনের সঙ্গে খুব ভাব ছিল।
না এভাবে শুরু করা যায় না। পৃথিবীর কোন স্বামীই বিয়ের পরদিন এ ধরনের কোন কথা শুনতে চায় না। কোন স্বামীই গোপন সত্য শুনতে চায় না। তারা শুনতে চায় মধুর মিথ্যা।
একসময় একজনের সঙ্গে খুব ভাব ছিল এটা এমন ভয়াবহ কোন ব্যাপারও নয়। ভাবতো থাকতেই পারে। তবে খুব ভাব ছিল— সমস্যাটা এইখানেই। খুব বলে একটা ছোট্ট বিশেষণ আছে। আমি ইচ্ছা করে বসাই নি। নিজের অজান্তেই চলে এসেছে।
উনার নাম…।
থাক নামটা বাদ থাক। নামের দরকার নেই। উনি ছিলেন। আমাদের কলেজের ইতিহাসের শিক্ষক। বয়স অল্প। পাস করে প্রথমেই এই কলেজে এসেছেন। এখানেই তার চাকরি জীবনের শুরু। তাকে দেখে আমাদের মেয়েদের মধ্যে খুব হাসা।হাসি পরে গেল। হাসাহাসির প্রধান কারণ তাঁর পরনে জোব্বা ধরনের পোশাক। গোড়ালী পর্যন্ত পায়জামা। থুতনীতে ছাগল দাড়ির মত ফিনফিনে এক গোছা দাড়ি। তিনি চোখে সুরমা দেন। ক্লাসে যখন পড়ান। তখন কখনো মেয়েদের দিকে তাকান না। মেঝের দিকে তাকিয়ে পড়ান। হঠাৎ কারো চোখে চোখ পড়ে গেলে লজ্জায় লাল হয়ে যান। তবে পড়ান খুব সুন্দর। এরকম অল্প বয়স্ক একজন মৌলানাকে বেছে বেছে তারা মেয়েদের কলেজে কেন দিল কে জানে। কলেজের সব স্যারদের নাম থাকে। তাঁর নাম হল চেংড়া হুজুর।