আপা!
কি?
এসো তোমার সুটকেস গুছিয়ে দেই। কি কি জিনিস নিয়ে তুমি ঢাকা যাবে বের করে দাও, আমি গুছিয়ে দেই।
আমি কিছুই নেব না।
এক কাপড়ে তো তুমি ঢাকায় উঠবে না। তোমাকে অনেক কিছুই নিতে হবে। তুমি জিনিসগুলো বের করে দাও, আমি গুছিয়ে দেই। এতে তোমার লাভ হবে। আপা।
কি লাভ?
তোমার সময় কাটবে। সময় কাটানো এখন তোমার খুব সমস্যা। আমি তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি।
যে মেয়ের এখনো বিয়ে হয় নি। সে স্বামীর কাছে যাবার জন্যে সুটকেস গুচ্ছাচ্ছে–এই দৃশ্য ভাবতেও লজ্জা লাগে। আমি চুপ করে রইলাম। ইরা খাটের নিচ থেকে কালো রঙের বিশাল সুটকেস বের করে ঝাড়ামোছা করতে লাগল। বড় মামার স্বভাবের খানিকটা ইরার মধ্যে আছে। সেও খুব গোছানো। আমি কিছু বলি আর না বলি সে ঠিকই সুটকেস গুছিয়ে দেবে। আমি ঢাকায় পৌঁছে সুটকেস খুলে দেখব–আমার যা যা প্রয়োজন সবই সেখানে আছে।
মা এসে ঢুকলেন। তাঁর গা থেকে ভুড় ভুড় করে এলাচের গন্ধ আসছে। মনে হয় পোলাও-কোরমা বসিয়ে দিয়েছে।
নবনী?
জ্বি মা।
আয় তোকে গোসল দিয়ে দি। ইরা তুই আয়।
আমি নিঃশব্দে উঠে এলাম। বাথরুমটা ছোট। দুজন মানুষেরই সেখানে জায়গা হয় না। তার মধ্যে বড় একটা বালতি রাখায় দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই।
ইরা বলল, মা, আপাকে বরং ছাদে নিয়ে যাই।
মা ভীত গলায় বললেন, কেউ যদি আবার দেখে-টেখে ফেলে?
ইরা কঠিন গলায় বলল, দেখলে দেখবে।
মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আচ্ছা যা, ছাদে নিয়ে যা। এই ভারী বালতি কে টেনে তুলবে? অন্তু তো এখনো এল না। কোন একটা কাজ যদি সে ঠিকমত করে। মোরগ এনেছে কালো হয়ে আছে পায়ের চামড়া। একশ বছরের বুড়া মোরগ। দশ বছর ধরে জ্বাল দিলেও সিদ্ধ হবে না।
ইরা বলল, মুরগি সিদ্ধ না হলে না হবে। তুমি এত চিন্তা করো না তো মা। দরকার হলে ওরা ছরতা দিয়ে মাংস কেটে খাবে। তুমি টেনশান ফ্রি থােক। অন্তু ভাইয়া আসুক। সে আসার পর গায়ে-হলুদ হবে।
মা বললেন, আচ্ছা। ইরা বলল, তাহলে সন্ধ্যার পরই গায়ে-হলুদ হবে। সন্ধ্যার পর করলে কেউ কিছু দেখবেও না। ভাইয়াকে বাদ দিয়ে কি আর গায়েহলুদ হবে?
মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আচ্ছা আচ্ছা। কেন জানি মা ইরাকে খুব ভয় পান।
গোসল করে আপা হলুদ শাড়ি পরবে না? শাড়ি তো নেই। তুমি টাকা দাও, আমি হলুদ শাড়ি কিনে আনিব।
তুই কিনে আনবি, কেউ যদি কিছু জিজ্ঞেস করে?
জিজ্ঞেস করলে বলব, আমার বড় আপার বিয়ে। আমি এমন ফকিরের মত আপার বিয়ে হতে দেব না।
আচ্ছা আচ্ছা, যা, চিৎকার করিস না। অন্তু আসুক, ওকে নিয়ে দোকানে যাবি। তুই একটু রান্নাঘরে আসবি? আমাকে সাহায্য করবি?
না, আমি অন্য কাজ করছি।
মা আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন। ভাজা ঘিয়ের গন্ধ আসছে। কি কি রান্না হচ্ছে একবার গিয়ে দেখলে হত। এত কিছু রান্না সব মার একা করতে হচ্ছে। আমাদের কাজের মেয়ে দু দিনের ছুটি নিয়ে দেশে গেছে, এখনো আসছে না। আসবে বলে মনে হয় না। এক দোকানদারের সঙ্গে খুব খাতির ছিল। সেখান থেকে কোন সমস্যা বাঁধিয়েছে কি-না কে জানে। ইরার ধারণা ঘোরতর সমস্যা। তাকে না-কি গোপনে বলছে।
আমি বারান্দায় খানিকক্ষণ এক-একা দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি ইজিচেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর কোলের উপর রাখা খবরের কাগজ ফর ফর করে বাতাসে উড়ছে। তিনি দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুমান। আজ সে সুযোগ হয় নি।
রান্নাঘর থেকে হাঁড়িকুড়ি নাড়ার শব্দ আসছে। আমি রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছি। আমাদের এ বাড়িটা হিন্দুবাড়ি। আমার দাদা এই বাড়ি জলের দামে এক হিন্দু ব্ৰাহ্মণের কাছ থেকে কিনেছিলেন। বেচারা এত সস্তায় একটিমাত্র কারণেই বাড়ি বিক্রি করে— দাদাজান যেন তার ঠাকুরঘরটা যে রকম আছে সে রকম রেখে দেন। সেই ঠাকুরঘরটাই আমাদের এখনকার রান্নাঘর।
মা আমাকে দেখেই বলল, তুই এখানে কেন? যা তো। যা।
আমি বললাম, এক-একা কি করছ? আমি তোমাকে সাহায্য করি।
কোন সাহায্য লাগবে না। তুই দরজা বন্ধ ঘরে চুপচাপ খানিকক্ষণ শুয়ে থাক।
রান্না-বান্না কদুর করেছ?
দুটা তরকারি নেমেছে। চেখে দেখবি?
না।
আমি নরম গলায় বললাম, মা, আমি বসি তোমার পাশে?
ধোঁয়ার মধ্যে বসতে হবে না। তুই যা।
আমি বুঝতে পারছি মার প্রচণ্ড পরিশ্রম হচ্ছে। কিন্তু তার চোখে-মুখে পরিশ্রমের ক্লান্তি নেই। মনে হচ্ছে তিনি খুব আনন্দে আছেন। প্রয়োজন হলে আজ সারারাত তিনি রান্না করতে পারবেন।
নবনী!
জ্বি মা।
বৃষ্টি হবে না-কি রে মা?
বুঝতে পারছি না। হবে মনে হয়। আকাশে মেঘা জমছে।
অবশ্যই বৃষ্টি হবে। শুভদিনে বৃষ্টি হওয়া খুব সুলক্ষণ। তোর বাবা কি করছে?
ঘুমুচ্ছে।
তুইও শুয়ে ঘুমিয়ে পড়। যা এখন। চা খাবি? বানিয়ে দেখ এক কাপ? পানি গরম আছে।
দাও, বানিয়ে দাও। দুকাপ বানাও মা। তুমি নিজেও খাও।
মা কেতলিতে চা-পাতা ছেড়ে দিলেন। মার রান্না-বান্না দেখার মত ব্যাপার। অসম্ভব রকম গোছানো ব্যবস্থা। আমি এখন পর্যন্ত কোন মহিলাকে এত দ্রুত এত কাজ করতে দেখি নি।
মশলা কি তুমিই বাটছ?
গুড়া মশলা আছে, কিছু নিজে বাটলাম। অস্তুকে বললাম, একটা ঠিকা লোক আনতে। কোথায় যে উধাও হয়েছে! কাজের বাড়ি, একজন পুরুষ মানুষ থাকলে কত সুবিধা।
কিছু লাগবে?
জিরা কম পড়েছে।
আমি এনে দেই মা। রাস্তার ওপাশেই তো দোকান।
হয়েছে, তোর গিয়ে জিরা আনতে হবে না। চা নিয়ে চুপচাপ বসে খা।