আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। কি বলছে এই মেয়ে? সে কি সত্যি এসব বলছে না। আমি ভুল শুনছি?
সফিক চিৎকার করে বললেন—চুপ কর। You are out of your mind.
তুমি চেঁচিও না। I am not out of my mind. I never was. যা বলছি ঠিকই বলছি। এই দারুণ রূপবতী এবং পুণ্যবতী মহিলার একটি অবৈধ মেয়ে আছে। এতিমখানায় বড় হচ্ছে।
আমি মূর্তির মত বসে রইলাম। নোমানের ঘুম বোধহয় ঠিকমতো ভাঙেনি। সে হতভম্ব হয়ে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে একবার অহনার দিকে। আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। আমি কি পানিতে পরে যাচ্ছি? সফিক ছুটে এসে আমাকে ধরে ফেললেন। শান্ত স্বরে বললেন–নোমান তুই অহনাকে নিয়ে যা। আমি নবনীকে দেখব। তুই চিন্তা করিস না। যা প্লীজ যা।
নোমান অহানার সঙ্গে চলে যাচ্ছে। আশ্চর্য সে একবারও পেছনের দিকে তাকাছে না। সফিক বললেন, নবনী তুমি কিছু মনে করো না। ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ও এরকম করে। আমি হাত জোড় করে ওর হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, সফিক ভাই! আপনি কি আমাকে আমার বড়মামার কাছে পৌঁছে দেবেন?
অবশ্যই দেব। তুমি যেখানে আমাকে নিতে বলবে আমি সেখানেই তোমাকে নিয়ে যাব। অহনার ব্যবহারে আমি যে কি পরিমাণ লজিত তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।
আপনার লজ্জিত হবার কিছু নেই। আমি দীর্ঘদিন মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলাম। আমার জীবনের একটা অংশ আমার কাছে অস্পষ্ট। আমার ধারণা অহনা ভাবী সত্যি কথাই বলেছেন।
আমার এমন লাগছে কেন? শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আমি নৌকার উপর বসে আছি। নৌকাটা খুব দুলছে। এত দুলছে কেন নৌকাটা? নৌকার পাটাতনে এটা কি কাক না? ঐ বুড়ো কাকটা না? আবার কতদিন পর কাকটাকে দেখলাম— আমি বললাম, এই এই আয়।
তলপেটে তীব্র ব্যথা হচ্ছে। আমার শরীর একটি শিশু বাস করছে। ওর কোন ক্ষতি হচ্ছে নাতো? ও ভাল থাকবে তো? প্ৰচণ্ড মানসিক যাতনায় না-কি আপনা। আপনি এবোরসান হয়ে যায়। এটা যেন না হয়। সব কিছুর বিনিময়ে আমি তার মঙ্গল চাই।
নবনী তোমার কি খারাপ লাগছে? এক কাজ কর এই পাটাতনে শুয়ে পর। তাকিয়াটা মাথার নিচে দাও।
সফিক ভাইয়ের কথা খুব অস্পষ্ট শোনাচ্ছে। তিনি আমাকে শুইয়ে দিলেন। চাঁদটা এখন ঠিক আমার চোখের উপর। চাঁদের আলো এত তীব্ৰ হয়? আমার চোখ বলছে যাচ্ছে।
নদী থেকে পানি নিয়ে তিনি আমার চোখে মুখে দিচ্ছেন। শান্তি শান্তি লাগছে। নদীর পানি এত ঠাণ্ডা।
নবনী শোন, হা করে নিঃশ্বাস নাও। হা করে নিঃশ্বাস নিলে ভাল লাগবে।
আমি নিজের জন্যে না। আমার বাচ্চাটির জন্যে হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। এই পৃথিবীতে তাকে আসতেই হবে।
আমার ঘুম ঘুম পাচ্ছে। আমি প্ৰায় ফিসফিস করে বললাম, সফিক ভাই। আমার পেটে তিন মাসের একটা শিশু আছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এবোরসান হয়ে যাবে। প্ৰচণ্ড ব্যথা হচ্ছে।
তুমি নড়বে না। যেভাবে আছ সেই ভাবে শুয়ে থােক। একটুও নড়বে না।
তিনি দৌড়ে চলে যাচ্ছেন। একটু বাতাস নেই তারপরেও নৌকাটা এত দুলছে কেন? মনে হচ্ছে। আমি গড়িয়ে পানিতে পড়ে যাব। নৌকার পাটাতনে বুড়ো কাকটা গুটি গুটি পায়ে আসছে আমার দিকে। আমি বললাম, এই যা যা। কাউকেই এখন আমার কাছে আসতে দেয়া যাবে না। নিজেকে রক্ষা করতে হবে। শিশুটির জন্যেই নিজেকে রক্ষা করতে হবে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। আধো ঘুম আধো জাগরণে বুঝতে পারছি— আমার শরীরের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা শিশুটিকে রক্ষা করার যে প্রচণ্ড তাগিদ অনুভব করছি, এরকম তাগিদ। আগেও একবার অনুভব করেছিলাম। আমার আজকের অনুভূতি নতুন নয়। আরো একবার জীবন বাজি রেখেছিলাম একটি শিশুর জন্যে। অস্পষ্ট ধোয়ার মত স্মৃতি, গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা। বড় মামা আমাকে নিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে গিয়েছিলেন। যেন কেউ আমার খোঁজ না জানে। মামা কেন এই কাণ্ডটি করেছিলেন এখন স্পষ্ট হচ্ছে।
কেমন আছে আমার ঐ বাচ্চাটা? কত বড় হয়েছে? ওকি ওর বাবার মত হয়েছে? পরিচয়হীন ঐ মেয়েটির মাথায় ভালবাসার মঙ্গলময় হাত কেউ কি ফেলবে না?
চাঁদটা মনে হচ্ছে আকাশ থেকে নেমে আসছে। কি তীব্র তার আলো?
রক্তে আমার শাড়ি ভিজে যাচ্ছে। এত রক্ত মানুষের শরীরে থাকে?
পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এত রক্ত পায়ের শব্দ। নোমান কি আসছে? সে যদি আসে তাহলে তাকে একটা কথা বলে যেতে চাই। কথাগুলো বলার মত শক্তি আমার থাকবেতো? আমি বলব, এই দেখ আমি মরে যাচ্ছি। যে মানুষ মরে যাচ্ছে, তার উপর কোন রাগ কোন ঘেন্না থাকা উচিত না। আমি অনেককাল আগে একটা মানুষকে যে ভাবে ভালবেসেছিলাম তোমাকেও ঠিক সেই ভাবেই ভালবেসেছি। ভালবাসার দাবি আছে। সেই দাবি খুব কঠিন দাবি। ভালবাসার সেই দাবি নিয়ে তোমার কাছে হাত জোড় করছি। আমার একটা মেয়ে আছে। কোন একটা এতিমখানায় বড় হচ্ছে তুমি কি ওকে তোমার কাছে এনে রাখবে? প্রথমে হয়ত তাকে ভালবাসতে পারবে না। কিছুদিন পর অবশ্যই পারবে। ওতো আমারই একটি অংশ। আমিতো তোমাকে ভালবেসেছি।
এক খণ্ড বিশাল মেঘ চাদটাকে ঢেকে দিয়েছে। চাঁদের আলো এখন আর চোখে লাগছে না। চারদিকে কি সুন্দর লাগছে। কি অসহ্য সুন্দর। হতাশা, গ্লানি, দুঃখ ও বঞ্চনার পৃথিবীকে এত সুন্দর করে বানানোর কি প্রয়োজন ছিল কে জানে?*
————-
* নবনীর প্রতিটির চরিত্র কাল্পনিক।