আমি এ রকম কিছু ভাবছি না।
না ভাবাই ঠিক। ঘৃণা থেকেও ভালবাসা জন্মায়। আমার প্রতি ওর যে প্রবল ভালবাসা তা উঠে এসেছে ঘৃণা থেকে। সমস্যা এইখানেই। এই পৃথিবীতে দুধরনের মানুষ খুন হয়। প্রবল ঘৃণার মানুষ এবং প্রচণ্ড ভালবাসার মানুষ। কাজেই অহানা যদি আমাকে মেরেও ফেলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, উল্টাটাওতো হতে পারে। তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, হতে পারে। অবশ্যই হতে পারে।
ছবির স্যুটিং
নোমান বলছিল ছবির স্যুটিং খুব বিরক্তিকর। আমি দেখছি ব্যাপারটা মোটেই সে রকম না। আমার বিরক্তিতো লাগছেই না। বরং মজা লাগছে। আমি ছবির কিছুই জানি না। তবু বুঝতে পারছি। সফিক সাহেব ছবির কাজ খুব ভালই বুঝেন। একেবারে এলাহি কারবার। দিনের বেলা কাজ হচ্ছে অথচ মাঠের মাঝখানে মাঝখানে লাইট জ্বলছে। বড় বড় রাংতা মোড়া বোর্ড হাতে লোকজন ছোটাছুটি করছে। এই বোর্ডগুলো রিফ্রেকটর।
ক্যামেরাম্যান একজন বিদেশী, কলিন্স বোধহয় নাম। অসীম ধৈর্য এই সাহেবের। ঝাঁঝাঁ রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে।
সারাদিন ধরে একটা দৃশ্য হচ্ছে। জাহেদা ছুটতে ছুটতে বনে ঢুকে গেল।
সফিক সাহেব বললেন, দৃশ্যটা এমনভাবে নিতে হবে যেন দর্শকের মনে ভয়ের ছাপ পড়ে। মেয়েটা যখন দৌড়ে যাবে তখন মাঠে কয়েকটা ছাগল থাকবে। মেয়েটার দৌড়ে যাওয়া দেখে ছাগলগুলো উল্টো দিকে ছুটতে থাকবে। এতে দৃশ্যটি অন্য রকম হয়ে যাবে। মেয়েটা যখন বনে ঢুকবে তখন বনের পাখিরা কিচকিচ করে উঠবে। এতে ভয়টা আরো বাড়বে।
উনার কথাগুলো আমার ভাল লাগল। বলতে ইচ্ছা করল বাহ বেশতো। অহনা অভিনয়ও করছে এত সুন্দর। ছাগলগুলো যখন তাকে দেখে ছুটছে তখন সে এক পলকের জন্যে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাকাল ছাগলগুলোর দিকে তারপর আবার ছুটতে শুরু করল। দাঁড়ানোর কথা সফিক তাকে বলেন নি। এটা সে করেছে নিজ থেকে।
সফিক বললেন, তোমার দাঁড়িয়ে পড়াটা খুব সুন্দর হয়েছে। ওয়ান্ডারফুল।
ক্যামেরাম্যান সাহেব বললেন, Well done!
অহনা হাসতে হাসতে বলল, থ্যাংকস।
সফিক বললেন, আজকের মত প্যাক আপ। কাল সকাল থেকে আবার সুটিং। আশা করছি কাল দিনের মধ্যে শেষ করে ফেলব।
অহনা বললেন, আমি আজ আরো খানিকক্ষণ কাজ করতে রাজি আছি। আজ আমার কাজ করতে খুব ভাল লাগছে।
সফিক বললেন, আজ থাক। আমি টায়ার্ড। কলিন্সের দিকে তাকিয়ে দেখ রোদে টমেটোর মত লাল হয়ে গেছে। নোমান বেচারাও টায়ার্ড। ছাগলের পেছনে দৌড়ে দৌড়ে তার অবস্থা কাহিল। এসো নৌকায় বসে সবাই চা খাই।
অহনা বললেন, চল যাই।
সফিক বললেন, আজ চাঁদনী আছে। রাতের খাবার পর আমরা কিছুক্ষণ নৌকায় করে ঘুরব। কি বল অহনা?
আচ্ছা যাও ঘুরব।
রাতের নৌকায় গানের আসর হবে। অহনা দু একটা গান কি আজ আমাদের শুনাবে?
অহনা হাসতে হাসতে বললেন, খুব ভালমত অনুরোধ করলে শুনাতেও পারি।
অনুরোধ মানে তুমি চাইলে আমি সবার সামনে দূর থেকে ক্রলিং করে এসে তোমার পায়ে ধরতে পারি।
সফিক হাসছেন। অহনা হাসছেন। কে বলবে এদের মধ্যে কোন সমস্যা আছে। এদের হাসি কৃত্রিমও নয়। সহজ সরল হাসি। এই হাসির উৎস ভালবাসা। অন্য কিছু নয়। সেই ভালবাসার জন্ম যদি ঘৃণাতে হয় তাতে কিছু যায় আসে না।
রাতে অনেকক্ষণ গান হল। নৌকা ঘাটে বাঁধা। বেশ বড় নৌকা। ছাদ খোলা। পাটাতনে তিরপল বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা চারজন শুধু আছি। সাহেব গান শুনতে আসেন নি। তিনি নাকি একা একা গাজা খাবেন। বাংলাদেশে এসেছেন আরাম করে গাঁজা খাবার জন্যে। নোমান আজকের দিনের পরিশ্রমের জন্যেই বোধহয় পাটাতনে কান্ত হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। বেশ কয়েকটা তাকিয়া আছে। বেচারার মাথার নিচে একটা দিয়ে দিলে আরাম করে ঘুমাতে পারত। আমার দিতে লজা লাগছে।
সফিক সাহেব বসেছেন অহনার পাশে। আমি অন্য দিকে। অহনা পরপর তিনটি গান করলেন। সবার শেষে গাইলেন
নিশীথে কী করে গেল মনে কী জানি, কী জানি।
সে কি ঘুমে, সে কি জাগরণে কী জানি, কী জানি।।
গাইতে গাইতে টপ টপ করে তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। চাঁদের আলোয় কান্নাভেজা মুখ এত সুন্দর দেখায়? আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। মনে মনে ভাবছি। এমন একটি গুণী মেয়েকে ভালবেসে কষ্ট পাওয়াতেও আনন্দ আছে। এদেরতো অঞ্জলি পেতেই ধরে রাখতে হয়।
অহনা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে হঠাৎ কঠিন স্বরে বললেন, রাত একটার সময় এখান থেকে একটা ট্রেন যাবে ঢাকায়। আমি ঐ ট্রেনে চলে যাব। নোমান যাবে আমার সঙ্গে।
সফিক অবাক হয়ে বললেন, তার মানে?
অহনা বললেন, মানে টানে জানি না। আমার ভাল লাগছে না। এই নোমান উঠতো। ওঠ। তুমি আমাকে নিয়ে ঢাকা যাবে।
সফিক বললেন, তোমার যদি যেতেই হয় তুমি যাবে কিন্তু একা যাবে কেন? আমরা সবাই যাব। তুমি চলে গেলে আমরা এখানে থেকে করব কি?
না। আমি একা যাব। তোমরা পরে আসবে। শুধু নোমান আমার সঙ্গে যাবে।
সফিক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, দেখ অহনা–নোমানের স্ত্রী এখানে আছে। সে তার স্ত্রীকে ফেলে চলে যাবে এটা তুমি কেন ভাবছ? হঠাৎ করে তোমার কি হয়েছে। আমি জানি না। তবে তুমি পাগলের মত আচরণ করছি।
মোটেই পাগলের মত আচরণ করছি না। যা করছি ঠাণ্ডা মাথায় করছি।
নোমান তোমার সঙ্গে যাবে। আর তার স্ত্রী এখানে থাকবে?
অহনা তীব্ৰ গলায় বলল, হ্যাঁ এতে তেমন কোন সমস্যা হবার কথা না। আশা করা যেতে পারে গভীর রাতে তুমি তার ঘরের দরজায় ধাক্কা দেবে না। আর যদি দাও তাতেও ক্ষতি নেই এই মেয়ের অন্য পুরুষের সঙ্গে শুয়ে অভ্যাস আছে।