এখন উনি কোথায় আছেন?
জানি না কোথায়। আমি জানি না, সফিকও জানে না। তবে সফিকের বোধহয় ধারণা হয়েছে আমি জানি তার কাছে লুকাচ্ছি।
রাতের খাবার জন্যে ভাত রাঁধতে বসেছি নোমান পাশে এসে বসল। নরম গলায় বলল, জানি করে এসেছ এখন চুলার কাছে বসতে হবে না। চল বাইরে কোথাও যাই খেয়ে আসি। চাইনিজ খাবার আমার অসহ্য লাগে– তবু চল যাই।
আমরা বাইরে খেতে গেলাম। ও খাবারের মেনু অনেকক্ষণ চোখের সামনে ধরে রেখে বলল, শালার দাম কি রেখেছে। খেয়ে না খেয়ে দাম। একবাটি সুপ তার দাম একশ কুড়ি টাকা। পানি ছাড়া এর মধ্যে আর কি আছে। নবনী চল এক কাজ করি এক বাটি সুদৃপ খেয়ে চলে যাই। টাকা পয়সা এখন খুব সাবধানে খরচ করতে হবে। আমার ধারণা সফিক আমার চাকরি নট করে দেবে। গেট আউট করে দেবে।
নোমান চিন্তিত মুখে সু্যুপ খাচ্ছে। আমার খুব মায়া লাগছে। আহা বেচারা। শুধু স্যুপে কি তার পেট ভরবে?
নবনী!
কি?
অচেনা একটা লোককে নিয়ে বাসায় এসেছিলে রাগে আমার গা জ্বলে গেছে। ঐ দিন অফিসে এক লোক এসে উপস্থিত। তোমাদের ওদিকে বাড়ি। তোমাদের সবাইকে চেনে। আমি যত্ন করে বসায়েছি—চা খাইয়েছি তারপর ব্যাটা বলে কি নবনীর প্রথম পক্ষের সন্তানটি কি আপনার সঙ্গে থাকে?
তুমি কি বললে?
আমিতো। হতভম্ব। সফিক আমার সঙ্গে ছিল সে বলল, হ্যাঁ ওর সঙ্গেই থাকে। কেন দেখা করতে চান? শুধু যে এই একজন তা না। আগেও আরেকজন এসেছে আমাকে পায় নাই অফিসের লোকজনের সঙ্গে গল্প করে গেছে বিশ্ৰী সব কথাবার্তা।
আমি চুপ করে আছি। নোমান বলল, স্যুপ খেয়ে ক্ষিধে আরো বেড়ে গেল। একি যন্ত্রণা বল দেখি। একটা ফ্রায়েড চিকেন নিয়ে নিই?
না।
নবনী তুমি আগের চেয়ে আরো সুন্দর হয়েছ। এত সুন্দরী বৌ পাশে নিয়ে হাঁটাহাটি করতে অস্বস্তি লাগে। লোকে এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন আমি তোমাদের বাড়ির দারোয়ান। তুমি বাইরে বেরুবার সময় সাজগোজ একেবারেই করবে না।
আচ্ছা যাও করব না।
এত ভাল লাগছে তোমাকে দেখে।
আমি বললাম, আমাকে দেখে এত ভাল লাগছে তাহলে আজ আমাকে দেখে মুখটা এমন কাল করে ফেলেছিলে কেন?
মন মেজাজ অসম্ভব খারাপ। সফিক চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিলে খাব কি? একা থাকলে অসুবিধা ছিল না। এখন আমরা দুজন।
আমি চাপা গলায় বললাম, বাড়তেও পারে। কিছুদিন পর হয়ত দেখা যাবে তিনজন।
নোমান বলল, হ্যাঁ তাতো হবেই। চাকরি চলে গেলেতো ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকবে না।
ভিক্ষা করতে হলে করব। এই দেশে ভিক্ষা করা এমন অন্যায় কিছু না। সবাই ভিক্ষা করছে। আমরাও না হয় করব। তুমি এখন আরাম করে খাওতো। শুধু শুধু চিকেন খাবে কি করে কিছু ভাত নাও।
নোমান হাসি মুখে বলল, যা থাকে কপালে চল খাই। খাওয়া দাওয়ার পর আইসক্রিীম খাব। আইসক্রীম খেতে ইচ্ছা করছে। যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্তান্ন খরচ হচ্ছে যখন হোক।
রাতে দুজন ঘুমাতে গেছি। নোমান গান দিয়ে দিয়েছে। আমি বললাম, গান থাক। এসো তোমাকে দারুন আরেকটা খবর দেই।
কি খবর?
দিচ্ছি। এত তাড়া কিসের? তুমি আগে আমাকে একটু আদর কর। তারপর খবর শুনবে। আচ্ছা আমি যে কিছুদিন পাগল ছিলাম তা-কি তুমি জান?
জানব না কেন। জানি।
কে বলেছে?
অহনা বলেছে।
উনি কি ভাবে জানেন?
অহনা সব জানে। তোমার সঙ্গে যখন বিয়ে ঠিক হল তখনি সব খোঁজ খবর করেছে। তারপর বলেছে— মেয়েটা বেশ কিছুদিন মাথা খারাপ অবস্থায় ছিল। এখন সুস্থ, তুমি বিয়ে করতে পার, ভাল মেয়ে। বেশ ভাল।
আমি কঠিন গলায় বললাম, তিনি অনুমতি দিলেন। তারপর তুমি বিয়ে করলে?
নোমান জবাব দিল না। আমি ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখি সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তৃপ্তির ঘুম।
কলিংবেল
ক্রিং ক্রিং করে কলিংবেল বাজছে।
আমাদের বাসায়তো কলিংবেল ছিল না। কলিং বেল কোথেকে এল? নতুন কলিং বেল লাগিয়েছে না-কি? আমি অবাক হয়েই দরজা খুললাম। কে এসেছে সেটা দেখার চেয়ে কলিং বেলটা দেখার জন্যেই আমার আগ্রহ বেশি।
দরজা খুলে দেখি সফিক সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। আজো তাঁর গায়ে নীল হাফ সার্ট। তিনি কি নীল রঙের সার্ট ছাড়া আর কিছু পরেন না? তিনি চোখের সানগ্লাস খুলতে খুলতে বললেন, কেমন আছ নবনী!
আমি বললাম, ভাল।
কর্তা কোথায়?
ও বাজারে গেছে। কাঁচা বাজারে।
আমি কি অপেক্ষা করব তার জন্যে?
জ্বি বসুন। ওর আসতে মনে হয় দেরি হবে। হেঁটে গেছে। হেঁটে ফিরবে।
সফিক সাহেব ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, হোক একটু দেরি। এই ফাঁকে আমি বরং তোমার হাতের চা খাই। নোমানের ধারণা এই পৃথিবীতে তোমার চেয়ে ভাল চা আর কেউ বানাতে পারে না।
তিনি সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলেন। বসলেন বারান্দায়। আমি বললাম, আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন। বারান্দায় বসেছেন কেন?
কারো শোবার ঘরে ঢুকতে ভাল লাগে না। শোবার ঘর হচ্ছে খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। বাইরের লোকের সেখানে প্ৰবেশাধিকার থাকা উচিত না। তোমাদের বারান্দাটা সুন্দর।
আমি চা বানিয়ে দিয়েছি। একটু অস্বস্তি লাগছে কারণ শুধু চা দিতে হয়েছে। ঘরে কিছু নেই। একটা কিছু থাকলে ভাল হত। আমি দেখেছি খুব যারা বড়লোক তারা সাধারণ খাবার বেশ আগ্রহ করে খায়। তিনি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, নবনী! আমি নোমানের কাছে আসি নি। আমি আসলে তোমার কাছেই এসেছি। অফিস থেকে দেখলাম নোমান বাজারের ব্যাগ হাতে বেরুল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে তোমার কাছে চলে এসেছি। যাতে ওর সঙ্গে দেখা না হয়।