আমি চিঠি মার হাতে ফেরত দিলাম। মা আগ্রহ নিয়ে বললেন, সবটা পড়েছিস?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
বাবা হৃষ্টচিত্তে বললেন, তোর বড় মামার কাজ সব গোছানো। কোন ফাঁক নেই। ভেরী প্রাকটিক্যাল ম্যান। ভেরী ডিপেনডেবল। উনার ব্যবস্থা দেখেছিস? আগে থেকে কিছু বলবে না। সব ঠিকঠাক করে তারপর বলবে। মিনু, আরেক কাপ চা দাও দেখি। আজকের বড়াগুলোও হয়েছে মারাত্মক। মাখনের মত মোলায়েম। মুখে দেবার আগেই গলে যাচ্ছে। নবনী, তোর জন্যে দুটা রেখে দিয়েছি, খা। তুই একটা নে, ইরাকে একটা দে।
আমার বড়া খেতে ইচ্ছা করছে না। তবু বাবাকে খুশি করার জন্যে বড়া হাতে নিলাম। হাত বেয়ে তেল পড়ছে। বিশ্ৰী লাগছে। মা চলে গেছেন চা বানাতে। মা যেভাবে ছোটাছুটি করছেন, মনে হচ্ছে তাঁর বয়স অনেকখানি কমে গেছে। তাঁর তাকানোর ভঙ্গি, ছোটাছুটির ভঙ্গি সব কিছুতেই একটা খুকী-খুকী ভাব চলে এসেছে। বাবা ঝুঁকে এসে বললেন, নবনী, তোর মামা একটা গ্রেট ম্যান, কি বলিস?
হ্যাঁ বাবা।
বিয়ের মত এতবড় একটা ঝামেলা। কিন্তু আমরা কিছুই বুঝতেও পারছি না। সব অটোসিস্টেম হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষটা না থাকলে যে কি হত— ভাবতেও পারি না! আই লাইক হিম। অসাধারণ একজন মানুষ।
বড়মামা অসাধারণ একজন মানুষ এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু বাবা তাকে পছন্দ করেন এটা ঠিক না। বাবা তাকে পছন্দ করেন না। মাও করেন না। আমরা কেউই বোধহয় করি না। শুধু আমরা না, তাঁর পরিবারের কেউই তাকে পছন্দ করে না। অথচ তার জীবনের একমাত্ৰ লক্ষ্য অন্যের উপকার করা। আদর্শ মানুষ বলতে যা বোঝায় তিনি তাই। মনে হয়, আদর্শ মানুষকে কেউ পছন্দ করে না। আদর্শ মানুষ ডিসটিল্ড ওয়াটারের মত–স্বাদহীন। সমাজ পছন্দ করে অনাদর্শ মানুষকে। যারা ডিসটিল্ড ওয়াটার নয়–কোকা কোলা ও পেপসীর মত মিষ্টি কিন্তু ঝাঁঝালো।
আমি উঠে আমার ঘরে চলে গেলাম। ইরা সেখানে কাপড় ইন্ত্রি করতে বসেছে। টেবিল ক্লথ, জানালার পর্দা ইন্ত্রি হচ্ছে। আমাদের একটা ইলেকট্রিক ইন্ত্রি আছে। বড় মামা দিয়েছেন। ইলেকট্রিসিটি বেশি খরচ হবার ভয়ে এই ইন্ত্রি আমরা কখনো ব্যবহার করি না। আজ ব্যবহার হচ্ছে।
ইরা আমাকে দেখে ইন্ত্রির প্লাগ খুলে রাখল। ইরাকে কেন জানি খুব কাহিল। লাগছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। ওর বোধহয় রাতে ঘুম-টুম হচ্ছে না। ইরা খুব চাপা ধরনের মেয়ে। ওর কি হয়েছে তা সে কাউকেই বলবে না। আমি বললাম, ইরা, তোর কুমড়া ফুলের বড়া পড়ে আছে। খেয়ে আয়।
ইরা বের হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসে হাসিমুখে বলল, বাবা খেয়ে ফেলেছেন। শরীর দুলিয়ে ইরা হাসছে—সুন্দর লাগছে দেখতে।
আপা!
কি?
তোমার কেমন লাগছে বলো তো? এই যে হঠাৎ তোমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলা হল— বিয়ে…।
কোন রকমই লাগছে না।
সত্যি বলছো আপা?
আমি হাসলাম। এই মুহূর্তে আমার কোন রকমই লাগছে না। আমি সত্যি কথাই বলছি। হয়ত এমনও হতে পারে যে, ব্যাপারটা আমার কাছে এখনো বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। যখন সত্যি সত্যি বরযাত্রীরা চলে আসবে তখন হয়ত অন্য রকম লাগা শুরু হবে। বরযাত্রী কি আসবে শেষ পর্যন্ত? একবার রাত আটটায় বরযাত্রী আসার কথা। আমি সেজেগুজে অপেক্ষা করছি। রাত বারটায় খবর এল–তারা আসবে না। মা খবরটা শোনার পর হঠাৎ মেঝেতে পরে গেলেন। নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হতে লাগল। কি বিশ্ৰী অবস্থা।
ইরা বলল, কার সঙ্গে বিয়ে বুঝতে পারছে আপা?
না।
ভদ্রলোক ছিলেন রোগামত। ফর্সা। চোখে লালচে রঙের ফ্রেমের চশমা। সারাক্ষণ রুমাল দিয়ে চশমার কাচ পরিষ্কার করছিলেন। বসেছিলেন বেতের চেয়ারে। উঠার সময় পেরেক লেগে তাঁর পাঞ্জাবি খানিকটা ছিড়ে গেল। তিনি তখন খুবই অবাক হয়ে ছেড়াটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তুই এত কিছু দেখেছিস?
যার সঙ্গেই তোমার বিয়ের কথা হয় তাকেই আমি খুব মন দিয়ে দেখি।
কেন?
ইরা মাথা দুলাতে দুলাতে বলল, যার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে তার একটা ছবি আমার মনে আঁকা আছে। সেই ছবির সঙ্গে আমি মিলিয়ে দেখি।
ইরা খাটে পা বুলিয়ে বসছে। বাচ্চা মেয়েদের মত পা নাচাচ্ছে। সে মনে হয় আরো অনেক কিছু বলতে চায় কিন্তু আমার শুনতে ইচ্ছা করছে না।
আপা!
হুঁ।
যাঁর সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে তার চেহারা কেমন হওয়া উচিত তুমি জানতে চাও?
না। জানতে না চাইলেও আমি বলি তুমি শোেন-তোমার নিজেরও নিশ্চয়ই একটা কল্পনা আছে। তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখ। আমার ধারণা, একশ ভাগ মিলে যাবে। তোমার বরকে হওয়া উচিত অবিকল শুভ্রের মত।
শুভ্ৰ কে?
শুভ্ৰ হচ্ছে উপন্যাসের একটা চরিত্র। সবাই তাকে বলে কানাবাবা। চোখে কম দেখে এই জন্যে কানাবাবা। দেখতে অবিকল রাজপুত্রের মত। অসম্ভব ভদ্র, হৃদয়বান ছেলে। পৃথিবীর সব কিছুই সে বিশ্বাস করে। খুব অসহায় ধরনের ছেলে।
অসহায় কেন?
তার পৃথিবীটা একদম অন্যরকম। তার পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে মিল নেই। এই জন্যেই অসহায়। আপা, তোমার কল্পনা কি মিলছে?
না।
তোমার কল্পনাটা কি?
আমি কিছু বললাম না। ইরাও আর কিছু বলল না। কোন কিছু নিয়ে চাপাচাপি করা ইরার স্বভাব না। সে পা দুলাচ্ছে। আমি খানিকটা অসহায় বোধ করছি। অন্যদিন বিকেলে ছাদে হাঁটাহাঁটি করতাম। আজ ছাদে যেতে ইচ্ছা! করছে না। ঘরে বসে থাকতেও ভাল লাগছে না।
আমার বিছানার কাছে গল্পের বইটা পড়ে আছে। এই বইটা আর বোধহয় পড়া হবে না। বইটার নাম অদ্ভুত— তিথির নীল তোয়ালে। তবে বইটা অদ্ভুত না। সাদামাটা গল্প। বইয়ের নায়িকা তিথির সঙ্গে একসঙ্গে তিনটি ছেলের প্ৰেম। তিথি আবার খুব নোংরা নোংরা কথা বলতে ভালবাসে। পড়তে খারাপ লাগছিল না। এখানকার পাবলিক লাইব্রেরির বই। ফেরত পাঠাতে হবে।