শুকরিয়া। অশেষ শুকরিয়া। রেখে দাও।
আপনি নিজে নিজে খেতে পারবেন? না-কি আমি চামচ দিয়ে খাইয়ে দেব?
না না পারব। আমি পারব।
স্যার আমার চামচ দিয়ে খাইয়ে দিতে কিন্তু অসুবিধা নেই। আপনি যদি অস্বস্তি বা লজ্জা বোধ না করেন আমি খাইয়ে দিতে পারি। যদি পাপ হয় আমার হবে। আপনার হবে না। আপনি ঠিকই বেহেশতে যাবেন।
তিনি দুঃখিত গলায় বললেন, তুমি আমার ধর্ম কর্মটাকে এমন কঠিন দৃষ্টিতে দেখ কেন? আমিতো কারো কোন ক্ষতি করছি না। আমি নিজের মতো থাকি। এই নিজের মতো থাকতে গিয়ে তোমাকে যদি কোন কারণে কষ্ট দিয়ে থাকি তুমি কিছু মনে রেখ না।
আমি অস্বস্তির সঙ্গে বললাম, আপনি কষ্ট দেবেন। কেন? আমি কথার কথা বললাম। স্যার আমি যাই।
একটু বোস নবনী। বসতে ইচ্ছা না হয়–দাঁড়িয়ে থাক। আমি কয়েকটা কথা বলব। এই কথাগুলো তোমার জানা খুব জরুরি। আমি মানুষ হয়েছি এতিমখানায়। এতিমখানার জীবনটাতো আদর ভালবাসার জীবন না। কষ্টের জীবন। আমাদের একজন হুজুর ছিলেন আমরা ডাকতাম মেজো হুজুর। তিনি আমাদের সবাইকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ধর্ম কর্মের প্রতি আমার এই অনুরাগ তার কাছ থেকে পাওয়া। আমি মনে করি না এটা ভুল। মাদ্রাসা থেকে উলা পাস করে আমি কলেজে ভর্তি হই। আমার ভাগ্য ভাল ছিল, ইন্ডিয়া সরকারের একটা স্কলারশীপ পেয়ে যাই। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. করার একটা সুযোগ ঘটে। এম. এ. পাস করি।
আমি বললাম, স্যার আমাকে এত কথা বলার দরকার নেই।
তিনি খানিকটা উত্তেজিত গলায় বললেন, দরকার আছে। দরকার আছে বলেই বলছি–তোমরা আজ যে পোশাকে আমাকে দেখছি সব সময় এই পোশাকেই আমি সারা জীবন পরেছি। মেজো হুজুর সেই নির্দেশ আমাকে দিয়েছেন।
কোন দিলেন?
কারণ আমাদের নবী এই লেবাস পরতেন।
নবী আরবে জন্মেছিলেন বলে এই লেবাস পরতেন। তিনি যদি তুন্দ্ৰা অঞ্চলে জন্মাতেন তাহলে নিশ্চয়ই এই লেবাস পরতেন না। তখন গায়ে পরতেন সীল মাছের চামড়ার পোশাক। এই অবস্থায় আপনি কি করতেন? আপনিও কি সীল মাছের চামড়ার পোশাক জোগাড় করতেন?
নবীজী যেহেতু তুন্দ্ৰা অঞ্চলে জন্মাননি কাজেই সেই প্রশ্ন আসে না। তাছাড়া নবীজীর পোশাক পরার অন্য একটা অর্থ হল— তাকে সম্মান দেখানো। সম্মান দেখানোয়তো দোষের কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথকে সম্মান দেখাতে গিয়ে এক সময় অনেকে লম্বা দাড়ি রাখত বাবড়ি চুল রাখতো।
আমি চুপ করে গেলাম। স্যার সহজ ভঙ্গিতে বললেন, তুমি আমার সঙ্গে যুক্তিতে পারবে না। নবনী। বোধহয় তোমার ধারণা ছিল এই জাতীয় পোশাক পরা টুপীওয়ালা লোক সব অল্প বুদ্ধির হয়। এই রকম মনে করার কোন কারণ নেই। আমার বুদ্ধি ভালই আছে। আমার পড়াশোনাও অনেক। তোমাকে এত কথা বললাম কারণ… কারণ…।
কারণটা কি বলুন?
আরেকদিন বলব। আজ একদিনে অনেক বেশি কথা বলে ফেলেছি।
আপনি গুছিয়ে কথা বলতে পারেন।
না নবনী আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। তবে খুব গুছিয়ে চিন্তা করতে পারি।
একটা কাক যে আপনার কাছে আসতো সেটা কি আর আসে না?
আসে। বিকালের দিকে আসে। একা আসে না–তার কয়েকটা বন্ধুবান্ধব জুটেছে। সব কটাকে নিয়ে আসে। এরা কেউই আমাকে ভয় পায় না।
আপনাকে বোধহয় কাক মনে করে।
করতে পারে। পশুপাখির মনের কথা বোঝা বড়ই দুষ্কর। তবে কাক আমার খুব প্রিয় পাখি। এতিমখানায় যখন ছিলাম তখনও আমার কয়েকটা পোষা কাক ছিল।
কাক আপনার প্ৰিয় পাখি?
হুঁ।
কেন?
কাকই একমাত্র পাখি যে মানুষের কাছাকাছি থাকে, অন্য কোন পাখি কিন্তু মানুষের কাছে আসে না। তারা দূরে দূরে থাকে।
আপনার কি ধারণা আমাদের সবার কাক পোষা উচিত?
উনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হো হো করে হেসে উঠলেন। কোন মানুষকে এত আনন্দিত ভঙ্গিতে আমি হাসতে শুনি নি। আমার ইচ্ছা করতে লাগল। আমি আরো কিছু হাসির কথা বলে স্যারকে হাসিয়ে দি।
স্যার হাসি থামিয়ে বললেন, এক হাসিতে আমার অসুখ অনেকখানি কমে গেছে। এখন ঘরে যাও নবনী।
না। আমি ঘরে যাব না।
তোমার পড়াশোনা আছে। পড়াশোনা কর। রুগীর পাশে এতক্ষণ থাকা ঠিক না।
আমার ঠিক অঠিক আমি বুঝব আপনাকে এই নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
তিনি একটু যেন ভয়ে ভয়ে বললেন, তুমি আমার কাছে কি চাও বলতো নবনী।
আমি কিছু চাই না। স্যার অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে ক্লান্ত গলায় বললেন, আমার কাছে দুটি চিঠি কি তুমি লিখেছিলে?
জানি না। লিখতেও পারি।
শোন নবনী, তুমি একটা অসম্ভব ভাল মেয়ে। আমি চাই না আমার কারণে তোমার কোন ক্ষতি হোক।
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, ক্ষতির কথা আসছে কেন? কি আবোল তাবোল কথা বলছেন? স্যার আরেকটা কথা আমি কোন চিঠি ফিঠি কাউকে লিখিনি— আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই মৌলবীকে চিঠি লিখব। অসুখে আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আপনার এখানে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে।
স্যার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, আমি আর আপনার কাছে খাবার নিয়ে আসব না।
সেদিন রাতে খুব বৃষ্টি। আমি আবার তাঁর খাবার নিয়ে গেলাম। স্যারের ঘরে পা দেয়া মাত্র ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। স্যার ব্যস্ত গলায় বললেন, দাঁড়াও দাঁড়াও মোমবাতি আছে। মোমবাতি জ্বালাচ্ছি।
আমি অদ্ভুত গলায় বললাম–না মোমবাতি জ্বালাতে হবে না। অন্ধকারই ভাল।
স্যার চমকে উঠে বললেন, নবনী ঘরে যাও। প্লীজ ঘরে যাও। আমি বললাম, না।
কি প্ৰচণ্ড ঝড় হল সে রাতে। আমাদের শিরীষ গাছের একটা ডাল প্ৰচণ্ড শব্দে ভেঙে পড়ে গেল। হোক যা ইচ্ছা হোক। আজ আমার আর কিছুই যায় আসে না। প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। হোক বর্ষণ। সারা পৃথিবী তলিয়ে যাক।
ড্রেসিং টেবিল
আমাদের ড্রেসিং টেবিলটা চলে এসেছে। গাবদা ধরনের একটা জিনিস। আয়নাটাও বোধহয় সস্তা— মুখ কেমন বাঁকা দেখা যায়। যে পালিশের জন্যে এতদিন দেরী হল সেই পালিশে ড্রেসিং টেবিলের কোন উন্নতি বলে মনে হল না। ম্যাট ম্যাটে রঙ।