এই সময় কি হল? হযরত খানম জ্বরে পড়লেন। মাত্র ছয় দিনের জ্বরে তিনি মারা গেলেন। বাবরের বয়স তখন কত? কে বলতে পারে কত? নবনী তুমি বলতে পোর।
আমার শরীর কেঁপে উঠল। স্যার কি সুন্দর করে ডাকলেন নবনী। আর কেউ কি কোনদিন এত সুন্দর করে আমার নাম ডাকবে?
নবনী তুমি জান তখন বাবরের বয়স কত?
আমি চুপ করে আছি। আমার পেছন থেকে বেনু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার নবনী জানে কিন্তু বলবে না।
ক্লাসের সবাই হাসছে। স্যার সবার হাসি অগ্রাহ্য করে পড়াতে শুরু করলেন–হযরত খানমের মৃত্যুর চার দিনের দিন আরেকটি ঘটনা ঘটল…
ঘটনা সামান্য হলেও মুঘল সাম্রাজ্যে তার ফল ছিল সুদূর প্রসারী। আজ সেই সামান্য ঘটনা এবং তার পরবর্তী ঘটনা প্ৰবাহ তোমাদের বলব…। ইতিহাস থেকে আমাদের অনেক কিছু শিখতে হবে। আপাতত তুচ্ছ ব্যাপার যে এক সময় সাম্রাজ্য পরিবর্তনের মত বড় ব্যাপারে রূপান্তরিত হতে পারে। এই শিক্ষা বার বার ইতিহাস আমাদের দেয়। প্ৰথম চিঠিটি পাঠাবার এক সপ্তাহ পর আমি দ্বিতীয় চিঠিটি পাঠালাম। কোন চিঠিতে নাম ঠিকানা ছিল না। তবু স্যার ব্যাপারটা বুঝে ফেললেন। একদিন কলেজে রওয়ানা হচ্ছি। ওনার সঙ্গে দেখা। ওনি বললেন, নবনী শোন। তোমার তো পরীক্ষা এসে গেলো। এখন মন দিয়ে পড়াশুনা করা উচিত তাই না?
জ্বি।
তোমার হাতের লেখা সুন্দর। তবে হাতের লেখা সুন্দর হলেই তো হয় না–বানানের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। মুহূর্ত বানানে হ-য়ের নীচে আছে দীর্ঘ উকার।
আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললাম— আমাকে এসব কেন বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমি সেদিন কলেজে গেলাম না। বাড়িতে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে সারাদিন কাঁদলাম। সন্ধ্যাবেলা ছাদে উঠে মনে হল— ছাদ থেকে যদি নিচে লাফিয়ে পড়তে পারতাম তাহলে কি সুন্দর হত। কেন মানুষ শুধু শুধু পৃথিবীতে বেঁচে থাকে?…
নোমান ফিরল
সাতদিনের জায়গায় দশদিন পার করে নোমান ফিরল। রোদে পুড়ে চেহারা এমন হয়েছে যে তাকানো পর্যন্ত যায় না। এর সঙ্গে আছে কাশি। খুক খুক, খুক খুক কাশি লেগে আছে। ঘরে ঢোকার পর থেকেই কাশছে।
খুব পরিশ্রম হচ্ছে নবনী। ছবি তৈরি যে কি কঠিন কাজ তুমি ধারণাই করতে পারবে না। একটা সাধারণ দুই মিনিটের দৃশ্য করতে লাগল সারাদিন। দৃশ্যটা কি জান? দৃশ্যটা হল— নায়িকা পুকুর ঘাটে গোসল করতে গিয়েছে। একটা সবুজ কচুপাতায় তার গায়ে মাখা সাবানটা রাখা। হঠাৎ বাতাস লেগে সাবানটা পানিতে পড়ে গেল। নায়িকা পানিতে ড়ুব দিয়ে সাবান খুঁজছে।
অহনা তোমাদের নায়িকা?
হুঁ। আমাদের ছবিতে ওর নাম হল জাহেদা। গ্রামের মেয়ে হিসেবে তাকে যে কি মানিয়েছে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। স্টিল ছবি নেয়া আছে, তোমাকে দেখাব। এখন ভাল করে চা করা দেখি, চা খাব। আউট ডোরে থেকে থেকে চায়ের অভ্যাস হয়েছে।
আমি চা বানিয়ে এনে দেখি খাটে পা বুলিয়ে সে ভোস ভোঁস করে সিগারেট টানছে। তার শুধু যে চায়ের অভ্যাস হয়েছে তাই না। সিগারেটের অভ্যাসও হয়েছে।
নবনী!
উঁ।
গোসলের পানি দাও। গোসল করে বেরুব। অহনার খোঁজে যেতে হবে। ও রাগারগি করে কাউকে কিছু না বলে চলে এসেছে। আমরাতো কিছুই জানি না। সন্ধ্যাবেলা স্যুটিং। জাহেদা হাতে এক মুঠি পাঠখড়ি নিয়ে যাচ্ছে। পাটখড়ির মাথায় আগুন, সেই আগুনের আভায় পথ চলছে… দারুণ দৃশ্য। লাইট ফাইট করতে রাত দশটার মত বেজে গেল। সফিক আমাকে বলল, যা অহনাকে নিয়ে আয়। আমি আনতে গিয়ে শুনি সে সন্ধ্যাবেলা ব্যাগ গুছিয়ে স্টেশনের দিকে গেছে। বোঝ অবস্থা।
তোমাদের স্যুটিং হল না?
কিভাবে হবে? রাতে যে ফিরে আসব সেই উপায়ও নেই… ট্রেন হল পরদিন ভোর সাতটায়।
নোমান প্ৰায় এক ঘণ্টা লাগিয়ে গোসল করল।
মাথায় পানি ঢালে আর কাশে। কি বিশ্ৰী কাশি। এর মধ্যে এত ঠাণ্ডা লাগানো কি উচিত হচ্ছে? বাথরুম থেকে বের হয়ে সে কেমন জবু থবু হয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে কিছুতেই উৎসাহ নেই। বাসায় যে নতুন একটা কাজের মেয়ে আছে সেদিকে তার চোখ পড়ল না। তার পোষা ময়না সম্পর্কেও সে তেমন উৎসাহ দেখালো না। একবার শুধু বলল, ময়নাটাকে ঠিকমত খাওয়া দাওয়া দেয়া হয়েছে। নবনী? ব্যাস এই পর্যন্তই।
নোমান বলল, আরেক কাপ চা দাও নবনী। গোসল করে শরীরটা ফ্রেস হয়ে গেছে। তোমার একা একা অসুবিধা হয়নিতো?
না।
সফিক একবার বলছিল, তুই তোর বৌকে নিয়ে আয়–সে একা আছে।
নিয়ে গেলেই পারতে।
অহানা রাজি হল না।
রাজি হলেন না কেন?
অহনাকে বোঝা মুশকিল। ও কখন কি করে খুব স্ট্রেঞ্জ মেয়ে। ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ.। অনার্স, এম. এ. দুটাতেই ফার্স্টক্লাস। ইউনিভার্সিটিতে চাকরি পেয়েছিল— বলল চাকরি করবে না। ঘর সংসার করবে। বছর বছর বাচ্চা দিয়ে–ঘর ভর্তি করে ফেলবে, ছেলেপুলেয়… হা হা হা। এই যুগের কোন মেয়ের মুখে এই জাতীয় কথা শুনেছ?
না।
ওর আরো অদ্ভুত ব্যাপার আছে। এক সময় বলব। কই চা দিলে না?
আমি চা এনে দিলাম। নোমান চা শেষ করেই বের হয়ে গেল। তার চোখ টকটকে লাল। কে জানে হয়ত জ্বর এসেছে। মদিনা বলল, আম্মা লোকটা কে?
আমি বললাম, কেউ না।
ইচ্ছা করে বলা না। মুখ ফসকে বলে ফেলা।
নোমান জ্বর গায়ে রাত নয়টার দিকে ফিরল। চোখ লাল, জ্বরের ঘোরে শরীর কেঁপে উঠছে। আমি বললাম, অহনাকে পাওয়া গেল?
দেখা হয় নি, তবে খোঁজ পাওয়া গেছে। চলে গেছে রাজশাহী। তোমাকে বলেছি না–অদ্ভুত মেয়ে।