দু লাইনের চিঠি লিখতে মামার অনেক সময় লাগল। টপ টপ করে মাথা থেকে ঘাম ঝড়ছে। পানি চেয়ে পানি খেলেন।
আপনার শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে মামা?
না। ঘাম হচ্ছে জ্বর ছেড়ে দিচ্ছে বলে মনে হয়।
চিঠি শেষ করে মামা উঠে দাঁড়ালেন। দোয়া পড়ে ফুঁ দেয়ার পর্ব। আবার হল। আমি বললাম, মামা আমার ধারণা আপনার শরীর বেশি খারাপ আপনি রাতটা থেকে যান।
না রে বেটি না। জামাই এলেই চিঠিটা দিবি।
আমি কি পড়তে পারব মামা।
অবশ্যই পারবি। না পারার কি আছে?
ঘর থেকে বের হবার ঠিক আগে মামা বাথরুমে ঢুকে বমি করলেন। আমি মাথা মুছিয়ে দিলাম। মামা বললেন, বমি হয়ে যাওয়ায় ভাল হয়েছে। শরীরটা ফ্রেশ লাগছে। তুই আমাকে নিয়ে শুধু শুধু চিন্তা করিস না।
কি হয় একটা রাত থেকে গেলে।
খালি বাসা ফেলে এসেছি। না গেলে হবে না।
খালি বাসা কেন? মামী কোথায়?
আর বলিস না। খামাখা ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। কয়েকবার আনতে গেছি আসে না। ঝগড়া করে জীবনটা শেষ করল। বড়ই আফসোস। ঝগড়া দিয়ে জীবন শুরু করলে— ঝগড়া দিয়ে শেষ করতে হয়। এটাই নিয়তি।
মামা সিঁড়ি দিয়ে নামছেন আমি তাকিয়ে আছি। আমার খুব খারাপ লাগছে। বিচিত্র একটা মানুষ, সবার সমস্যাই তাঁর সমস্যা। কিন্তু কেউ জানতে চায় না–এই মানুষটার নিজস্ব কোন সমস্যা কি আছে।
নোমানের কাছে লেখা চিঠিটা পারলাম। মামা লিখেছেন–
বাবা নোমান,
দোয়াপর সমাচার এই যে, ঢাকায় কার্যোপলক্ষে আসিয়াছিলাম। তোমার সাহিত সাক্ষাত হয় নাই। বড় খুকীর নিকট সমস্ত বিস্তারিত জানিয়া সুখী হইয়াছি। এক্ষণে আমার একটি আবদার। বড় খুকীকে নিয়া এক দুই দিনের জন্য হইলেও নেত্রকোনা যাইবা। বড় খুকীর মাতা তাহার কন্যার জন্য বড়ই ব্যস্ত হইয়াছে। তাহাছাড়া ছোট খুকীরও বিবাহের কথাবার্তা হইতেছে। এমতাবস্থায় দুই বোন কিছু দিন একত্ৰ থাকিলে বড় ভাল হয়। বিবাহ সম্পন্ন হইলে কে কোথায় যাইবে কেহই বলিতে পারে না। হয়ত দীর্ঘদিন আর দুই বোনের সাক্ষাত হইবে না। কাজেই বাবা এই বৃদ্ধের প্রস্তাব একটু বিবেচনা করিবে।
আমি দেখলাম বড়মামা চিঠিতে নাম সই করতে ভুলে গেছেন। তাঁর শরীরটা তাহলে সত্যি সত্যি খারাপ করেছে। এত বড় ভুল মামা কখনোই করবেন না। পরিষ্কার করে নাম লিখবেন। তারিখ দেবেন, ঠিকানা দেবেন। নাম তারিখ এবং ঠিকানা ছাড়া চিঠি আমিও লিখেছি। দুটা চিঠি। দুটাই স্যারকে লেখা। প্রথমটা যখন লিখি তখন থর থর আমার হাত পা কাঁপছে। কি লিখছি নিজেই জানি না। কাউকে চিঠি লিখতে হলে গুছিয়ে লিখতে হয় সুন্দর করে লিখতে হয়। এসব কিছুই আমার মাথায় নেই। তাঁকে চিঠি লিখছি। এই আনন্দেই আমার তখন শরীর কাঁপছে। প্রথম চিঠিতে তাঁকে কি লিখেছিলাম। আমার কিছুই মনে নেই। আমার স্মৃতিশক্তি ভাল। সবকিছুই আমার মনে থাকে। কিন্তু ঐ চিঠিটির কথা কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে রোলটানা কাগজে চিঠিটা লেখা। যে বল পয়েন্টে লিখছিলাম। সেই বল পয়েন্টটা ঠিকমত কালি ছাড়ছিল না। অনেকগুলো অক্ষর ছিল অস্পষ্ট। চিঠি শেষ করে আমি দুহাতে মুখ ঢেকে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। আমি পোষ্ট আপিস থেকে নিজেই খাম। কিনলাম। খাম কেনার সময় মনে হল যিনি খাম দিচ্ছেন তিনি সব বুঝে ফেলেছেন। তিনি জেনে গেছেন–এই চিঠি আমি কাকে দিচ্ছি। কি আছে চিঠিতে।
ইকনমিক্সের একটা বাইয়ের ভেতর খামটা লুকিয়ে আমি যাচ্ছি। চিঠি পোস্ট করতে পথে বাবার সঙ্গে দেখা। বাবা বললেন, কই যাচ্ছিস রে? আমার শরীর কেঁপে উঠল। আর মনে হল বাবা বুঝে ফেলেছেন আমি কোথায় যাচ্ছি। তিনি জানেন আমার এই বইটার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একটা খাম আছে।
কি রে কথা বলছিস না কেন? কি হয়েছে তোর?
বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি।
এখন কলেজ আছে না? কলেজ বাদ দিয়ে বন্ধুর বাসায় কি?
ওখান থেকে কলেজে যাব।
আচ্ছা যা। তোর কি শরীর খারাপ?
না। বাবা শরীর ভাল।
আচ্ছা আচ্ছা।
চিঠি পোস্ট করে আমি কলেজে গেলাম। থার্ড পিরিয়ডে স্যারের ক্লাস। আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। স্যার ক্লাসে ঢুকলেন সব মেয়েরা উঠে দাঁড়াল। আমি দাঁড়াতে পারলাম না। মনে হচ্ছে আমার হাত-পা পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে।
স্যার রোল কল করছেন। মেয়েরা নানান রকম ফাজলামি করছে। ইয়েস স্যার না বলে সবাই বলছে হাজির হুজুর। একজন বললো— বান্দা হাজির হুজুর। হাসির হল্লা শুরু হল। স্যার রোল কল বন্ধ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। মনে হল কিছু বলবেন। বললেন না। রোল কল করে যেতে লাগলেন। আমার রোল তিপান্ন। যখন তিনি ডাকলেন রোল ফিফটি খ্ৰী। আমি চুপ করে রইলাম। কোন শব্দ করলাম না। স্যার আবার ডাকলেন রোল ফিফটি থ্রী। আমি চুপ করে রইলাম। স্যার কৌতূহলী হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি মাথা নিচু করে আছি। আমার ধারণা হয়েছে স্যার আমার চোখের দিকে তাকালেই সব জেনে যাবেন। তখন আমি কি করব। এ লজ্জা আমি কোথায় রাখব?
স্যার সেদিন পড়ালেন সমাট বাবরের সিংহাসনের আরোহণ পর্ব। ক্লাসের হৈচৈ একসময় থেমে গেল। তিনি ভারী এবং খানিকটা কাঁপা গলায় গল্প বলার ভঙ্গিতে কথা বলছেন। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে হাত নাড়ছেন—
বাবরের মার নাম হযরত খানম।
দেখেছ কি অদ্ভুত নাম। এই নাম মনে রাখা সহজ না? খুব সহজ। আবার শোন বাবরের মা হযরত খানম। ৯১০ হিজরীর কথা। রবিউস-সানি। রবিউস সানি কি আগে একবার বলেছি। আজ আর বলব না।