গভীর দুঃখ ও বেদনার সাহিত্য আপনাকে জানাইতেছি যে, আমার মধ্যম পুত্ৰ হঠাৎ বলিতেছে সে এক্ষণ বিবাহ করবে না। আমি এবং তাহার মাতা তাহাকে বুঝানোর প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া বিফল মনোরথ হইয়াছি। তাহার সহিত আমাদের কিঞ্চিৎ মনোমালিন্যও হইয়াছে। যাহা হউক, আপাতত বিবাহ অনুষ্ঠান স্থগিত রাখা ভিন্ন কোন পথ দেখিতেছি না। পুত্র রাজি হইলে ইনশাআল্লাহ আবার ব্যবস্থা হইবে। তবে আপনারা অপেক্ষা করিয়া থাকিবেন। না। যদি কোন ভাল পাত্রের সন্ধান পান–কন্যার বিবাহ দিবেন। আমাদের দোয়া থাকিবে ইহা জানিবেন। শ্রেণীমত সকলকে সালাম ও দোয়া দিবেন।
এইসব চিঠি সব সময় সাধু ভাষায় লেখা হয়। হাতের লেখা হয় প্যাঁচানো। চিঠির উপর আরবিতে লেখা থাকে। ইয়া রব। প্রতিটি চিঠির ভাষা ও বক্তব্য এক ধরনের হয়। কেউ সাহস করে কথাটা লেখে না। কেউ লেখে না-আপনার মেয়ে খুব সুন্দর। আমাদের পছন্দ হয়েছে কিন্তু তার সম্পর্কে যে এত ভয়াবহ একটি গুজব আছে তা জানতাম না। জানার পর বিয়ে নিয়ে এগুতে আমাদের সাহস হচ্ছে না। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।
ইরা বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, আপা, এত দেরি করছ, কেন? হাতমুখ ধুতে এতক্ষণ লাগে?
আমি জবাব দিলাম না। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে দেখছি। আয়নার মানুষটার ভেতর মনে হয় প্রাণপ্ৰতিষ্ঠা হয়েছে। সে আমাকে অনেক কথা বলতে চাচ্ছে। এমন সব কথা যা আমি এই মুহূর্তে শুনতে চাই না।
আপা, তোমার চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
আমি বের হয়ে এলাম। বাবা বললেন, নবু মাকে বসার কিছু দাও না। ইরা ঘরের ভেতর থেকে মোড়া এনে দিল। বাবার সামনের ছোট্ট সাইড টেবিল দুকাপ চা। একটা প্লেটে কয়েকটা পাপড় ভাজা। বাবা নিজেই একটা কাপ আমার হাতে তুলে দিলেন। আমার লজ্জা-লজা লাগছে।
বাবা চায়ে চুমুক দিয়ে খুশি-খুশি গলায় বললেন, চা ভাল হয়েছে। ভেরী গুড। কি রে নবু, চা ভাল হয় নি?
আমি হাসলাম। রান্নাঘর থেকে মা গলা বের করে বললেন, তোমরা ধীরে সুস্থে চা খাও— কুমড়া ফুলের বড়া ভাজছি।
কুমড়া ফুলের বড়া আমার জন্যে ভাজা হচ্ছে। আমাদের বাড়ির পেছনে কয়েকটা কুমড়ো গাছ ফুলে ফুলে ভর্তি হয়ে গেছে। আমি কবে যেন কথায় কথায় বলেছিলাম— কুমড়ো ফুলের বড়া করতো মা। মা বিরক্ত গলায় বলেছিলেন, সব ফুল খেয়ে ফেললে কুমড়ো আকাশ থেকে পড়বে?
ইরা আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মা ইরার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, ইরা, তুই এখানে ঘুরঘুর করছিস কেন? তোকে কি করতে বলেছি?
অর্থাৎ মা ইরাকে সরিয়ে দিলেন। বাবাকে সুযোগ করে দিলেন–যেন তিনি আমার সঙ্গে একা কথা বলতে পারেন। বুঝতে পারছি বাবা ছোটখাট একটা বক্তৃতা দেবেন। এরকম বক্তৃতা তিনি আগেও কয়েকবার দিয়েছেন। এসব ঘরোয়া বক্তৃতার শুরুটা খুব নাটকীয় হয়। বাবা এমন কিছু কথা দিয়ে বক্তৃতা শুরু করেন যার সঙ্গে মূল বক্তব্যের কোন সম্পর্ক নেই। আজও সেই ব্যাপার হবে।
নবনী!
জ্বি বাবা।
সক্রেটিসের একটা কথা আছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। সক্রেটিস বলেছেন, মানুষের একটাই সৎ গুণ, সেটা তার জ্ঞান। আর মানুষের দোষও একটা। দোষ হল অজ্ঞানতা— Ignorance, পশুদের কোন গুণ নেই, কারণ তাদের জ্ঞান নেই। বুঝতে পারছিস?
পারছি।
সক্রেটিসের এই বাণী মনে থাকলে জীবনটা সহজ হয়। জটিলতা কমে যায়। ঠিক না মা?
হ্যাঁ।
আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। বাবা কি করে সক্রেটিস থেকে আমার বিয়ের ব্যাপারে আসবেন। তিনি নিশ্চয়ই চিন্তা-ভাবনা করে রেখেছেন। আমি বেশ আগ্রহ নিয়েই বাবার কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি। বাবা খুব গম্ভীর গলায় কলেজে লেকচার দেবার ভঙ্গিতে বললেন
বিয়ে নামক যে সামাজিক বিধি প্রচলিত আছে, তার মূল উদ্দেশ্য হল পূর্ণতা। একজন পুরুষ পূর্ণ হয় না যতক্ষণ না একজন সঙ্গিনী তার পাশে আসে। এই জ্ঞান পশুদের নেই। মানুষের আছে। বুঝতে পারছিস?
পারছি।
বিবাহ পশুদের প্রয়োজন নেই, মানুষের প্রয়োজন, কারণ সক্রেটিসের ভাষায় মানুষ সৎগুণসম্পন্ন প্রাণী। অর্থাৎ জ্ঞানী প্রাণী। পরিষ্কার হয়েছে?
জি।
তোর বড় মামা খবর পাঠিয়েছেন। হাতে-হাতে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিটা পড়লেই তোর কাছে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। মিনু, চিঠিটা দিয়ে যাও।
মা সঙ্গে সঙ্গে চলে এলেন। মা রান্নাঘরে চিঠি আঁচলে নিয়েই বসেছিলেন। বলে মনে হয়। তাঁর এক হাতে চিঠি। অন্য হাতে প্লেট ভর্তি কুমড়ো ফুলের বড়া। এই খাদ্যদ্রব্যটি আমার একার নয়। বাবারও প্রিয়। কোন বিশেষ আনন্দের ব্যাপার হলে ফুলের বড়া তৈরি হয়। তখন শিশুদের মতাই বাবা চোখ চকচক করতে থাকে।
বাবা গভীর আগ্রহে বড়া খাচ্ছেন। আমি চিঠি পড়ছি। মামার হাতের লেখা ডাক্তারদের লেখার মত— অপাঠ্য। এই চিঠি যেহেতু তিনি অনেক বেশি যত্ন নিয়ে লিখেছেন সেহেতু কিছুই পড়া যাচ্ছে না— আমি চিঠিতে চোখ বুলাচ্ছি। মা আমার পাশে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। অনেকদিন পর মার পরনে ইস্ত্রি করা সুন্দর শাড়ি। হাতে আজ দুগাছা সোনার চুড়িও পড়েছেন। চুড়িতে সোনা সব ক্ষয়ে গেছে। তামা বের হয়ে আছে। তবু চুড়ি পরা হাতে মাকে সুন্দর লাগছে। মার হাত ভর্তি চুড়ি থাকলে বেশ হত। যেখানে যেতেন রিনারিন করে হাতের চুড়ি বাজতো।
দোয়াপর সমাচার,
তোমাদের একটি আনন্দ সংবাদ দিতেছি। পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপায়— ঢাকার পাটির সংবাদ পাওয়া গিয়াছে/ তাহদের নিকট হইতে খবর পাইয়া আমি ঢাকায় চলিয়া যাই এবং কথাবার্তা বলি। তাহদের সহিত অনেক বিষয় নিয়া বিস্তারিত আলাপ হইয়াছে। আলোচনার ফলাফল নিম্নরূপ।
তাহারা নবনী মাকৈ পছন্দ করিয়াছে। ছেলে তাহার কিছু আত্নীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবসহ আগামী পরশু। ১২ই আগস্ট রাতের ট্রেনে নেত্রকোনা পৌঁছবে। আল্লাহ চাহেত ঐ রাতেই শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হইবে। পরদিন প্রাতে তাহারা নববধু নিয়া ঢাকা যাত্ৰা করিবে।
আমি এই সংবাদ তোমাদের শেষ সময়ে দিতেছি, কারণ আমি চাহি না তোমরা এই সংবাদ নিয়া হৈ-চৈ শুরু কর।
পাড়া প্রতিবেশী, নিকটজন, পরজন কেহই যেন কিছুই না জানে। শুভকর্ম আগে সমাধা হোক, তখন সবাই জানিবে। দশজনের মত লোকের খাবার আয়োজন করিয়া রাখিবে। মোজাম্মেল সাহেবকে বলিয়া তাঁহার জীপ গাড়িটি ইষ্টিশনে রাখিবার ব্যবস্থা করিবে। বিবাহ-সংক্রান্ত কোন আলাপ তাহার সঙ্গে করিবার প্রয়োজন নাই। অসীম গোপনীয়তা কাম্য।
বিবাহ পাড়াইবার কাজী আমি সঙ্গে নিয়া আসিব। বিবাহ রেজিষ্টি হইবে ময়মনসিংহ শহরে।
খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনের মধ্যে পোলাও, কোরমা, ঝাল গোশত, মুরগির রোস্ট রাখিবে। চিকন চালের সাদা ভাত যেন থাকে। মুরাব্বী কেহ থাকিলে সাদা ভাতাই পছন্দ করবেন। আমি বড় মাছ নিয়া আসার চেষ্টা করিব। মেছুনীকে বড় মাছের কথা বলিয়া রাখিয়াছি। ভাত এবং পোলাও বরযাত্রী অ্যাসার পর রাঁধিবে। দৈ-মিষ্টি অ্যামি সঙ্গে করিয়া নিয়া আসিব।
মুখ দেখিবার পর জামাইকে সেলামী হিসেবে এক হাজার টাকা দিলেই চলিবে। আমি একটি স্বর্ণের আঙটি প্রস্তুত করাইয়া রাখিয়াছি। স্যুটের কাপড় দিতে পারিলে ভাল হইত। আমি সন্ধানে আছি, ভাল কাপড় পাওয়া গেলে নিয়া আসিব।
নবনীকে চোখে-চোখে রাখিবে। যদিও জানি ইহার কোন প্রয়োজন নাই। তাহাকে ভালভাবে বুঝাইবে। অতীত নিয়া সে যেন চিন্তা না করে। গাঁতস্য শোচনা নাস্তি। আমি নিজেও তোহর সঙ্গে কিছু কথা বলিব। গায়ে-হলুদের একটা ব্যাপার আছে–ইহা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নহে। গায়ে-হলুদ হিন্দুয়ানী ব্যাপার, তবুও যেহেতু ইহা মেয়েদের একটা শখের ব্যাপার সেহেতু নিজেরা নিজেরা গায়ে-হলুদের ব্যবস্থা নিবে। কাহাকেও কিছু জানাইবার কোনই প্রয়োজন নাই। আসল কথা গোপনীয়তা। কেহ কিছু জানিবার আগেই কার্য সমাধা করিতে হইবে। আল্লাহ সহায়–অসুবিধা হইবে না।
নব-বিবাহিত দম্পতি যেহেতু তোমাদের বাড়িতেই রাত্রিযাপন করবে: সেহেতু তাহদের জন্যে একটা ঘর আলাদা রাখিবে। খাটে বিছাইবার জন্যে আমি একটা ভেলভেটের চাদর সঙ্গে নিয়া আসিতেছি। বরযাত্রীরা রাতে কোথায় থাকিবে তা নিয়াও দুঃশ্চিন্তাগ্ৰস্ত হইবে না। পাবলিক হেলথের ডাকবাংলোয় আমি তিনটে ঘরের ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছি। শুভ কার্যের পর পরই তাহদের সেখানে নিয়া যাইব। বাকি আল্লাহপাকের ইচ্ছা।
অতঃপর তোমাদের সংবাদ কি? আমার স্ত্রীর শরীর ভাল যাইতেছে না। সে বলিতে গেলে শয্যাশায়ী। শরীর খারাপের জন্য মন-মিজাজেরও ঠিকঠিকানা নাই। চিৎকার ও হৈ-চৈ করিয়া সবার জীবন সে অতিষ্ঠা করিয়া তুলিয়াছে। তাহাকে সঙ্গে আনা ঠিক হইবে না। আমি একাই আসিব। যাহা হউক, শুভ কাজ যেন নির্বিয়ে সম্পন্ন হয়। সে জন্যে তোমরা আল্লাহপকের দরবারে ক্রমাগত প্ৰাৰ্থনা করিতে থাক। আর বিশেষ কি লিখিব। দোয়া গো।