ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দুটা দশ। ও বিছানায় শুয়ে ঘুমুচ্ছে। বারান্দায় দরজা খোলা। তাকে যতটা সাবধানী এবং গোছানো বলে মনে হচ্ছিল। আসলে সে ততটা না। বারান্দার দরজা খোলা রেখে সে ঘুমাতো না।
আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চাঁদের আলো পড়েছে বারান্দায়। সরল ধরনের আলো আসত। সে রকম জটিল নকশাদার আলো নয়। ও জেগে থাকলে তাকে নিয়ে কিছুক্ষণ বারান্দায় বসা যেত। এমন চট করে ঘুমিয়ে পড়বে তা ভাবি নি। ওকে কি ডেকে তুলব?
আমি এসে তার গায়ে হাত রাখলাম। সে পাথরের মত হয়ে আছে। ঘুমন্ত মানুষের গা স্পর্শ করলে সে একটু না একটু নড়ে উঠবেই। নোমান নড়ল না। সমান তালে তার নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। আমরা দুজন পাশাপাশি হয়ে আছি। ওর গায়ের পুরুষ পুরুষ ঘামের গন্ধে আমি কি অভ্যস্ত হয়ে গেছি? আজতো তেমন খারাপ লাগছে না। বরং ইচ্ছা করছে। ওর গা ঘেঁসে ঘুমুতে। একটা হাত ওর শরীরে তুলে দিলে ওকি জেগে উঠবে? না-কি ঘুমের ঘোরে সে হাত সরিয়ে দেবে? দীর্ঘদিন ধরে সে নিশ্চয়ই একা একা ঘুমুচ্ছে। একা ঘুমিয়েই সে অভ্যস্ত। শরীরের উপর একটা বাড়তি হাতের চাপ কি সে সহ্য করবে?
জানালা গলে চাঁদের আলো আমাদের হাঁটুর উপর এসে পড়েছে। শরীরের একটি অংশ আলোকিত হয়ে আছে। নোমান বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। দুঃস্বপ্ন দেখছে কি? বারান্দায় কালো কাপড়ে ঢাকা ময়নাটাও ছটফট করছে। কে জানে হয়ত এরা দুজন একই সঙ্গে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। পাখিদের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন বলে কি কিছু আছে?
আমি ওর গা থেকে হাত সরিয়ে নিজের মত শুয়ে পড়লাম। শাড়ির আঁচলে শরীর ঢেকে শোয়া। পাশ ফিরতেই খাট নড়ে উঠল। এই খাটের পায়াগুলো সমান না, বড় ছোট আছে। একটু নড়লেই খটখট শব্দ হয়। আমি একটা হাত ওর গায়ে রাখলাম ও ধড়মড় করে উঠে বসে ভয়ার্তা গলায় বলল, কে?
আমি বললাম, কেউ না। তুমি ঘুমাও।
সে সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল। আবার তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। সে যে উঠে বসে, কে বলে চেঁচিয়েছে তা ঘুমের মধ্যেই করেছে। ঘুমন্ত মানুষের আচার-আচরণ আমার মত ভাল কেউ জানে না। রাতের পর রাত আমি অম্বুমো কাটিয়েছি। আমার পাশে শুয়ে ঘুমিয়েছে ইরা। আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি— ঘুমন্ত মানুষ কি করে। ঘুমন্ত মানুষের আচার আরণের ব্যাপারে আমাকে একজন এক্সপার্ট বলা যেতে পারে।
আজো ঘুম আসছে না। প্রচণ্ড ইচ্ছা করছে। ওকে ডেকে তুলে বলি–এই শোন আমার ঘুম আসছে না। আমার খুব খারাপ ধরনের একটা অসুখ আছে। আমার রাতে ঘুম হয় না। একা একা জেগে থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়। তুমি এসে আমার সঙ্গে বারান্দায় খানিকক্ষণ বস। আমার জীবনের ভয়াবহ একটা গল্প আছে। গল্পটা এখনো তোমাকে বলা হয় নি–আজ খানিকটা বলব।
চাঁদের আলো ওর হাঁটুর উপর থেকে সরে গেছে। এখন আলো এসে পড়েছে বিছানার উপর। যেন টর্চ ফেলে ফেলে কেউ বিছানাটা পরীক্ষা করছে।
আমি উঠে বসলাম। খাটটা আবার ক্যাচ করে শব্দ করে উঠল। ও বলল, কে? আমি এবার কোন জবাব দিলাম না। ও আবারো গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ল। খাঁচার ময়না পাখি খচ খচ শব্দ করছে।–
আশ্চর্যের ব্যাপার আমাদের স্যারেরও একটা পাখি ছিল। তিনি একটা কাক পুষেছিলেন। তার কোন খাঁচা ছিল না। কাকটা এসে প্রায় সারাদিনই রেলিং-এ বসে থাকত। কাকটার বোধহয় বয়স হয়ে গিয়েছিল। খাবার খুঁজে বেড়াবার সামর্থ্য ছিল না। কিংবা কে জানে হয়ত স্যারকে তার পছন্দ হয়েছিল।
স্যার যখন আমাদের বাড়িতে থাকতে এলেন তখন ব্যাপারটা আমার তেমন পছন্দ হয় নি। মৌলানা। টাইপের একজন লোক বাসায় থাকবে। নানা ধরনের উপদেশ দেবে। কি দরকার? বাড়ি ভাড়া দিয়ে আমাদের যে টাকা পেতে হবে এমনও না। কিন্তু বাবার তাকে খুব পছন্দ হয়ে গেল। তিনি দরাজ গলায় বললেন, সুফি টাইপের একজন মানুষ থাকছে। থাক না। অসুবিধা কি? পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে। আল্লাহ বিল্লাহ করবে। এই বাড়ি থেকেতো আল্লাহ খোদার নাম উঠেই গেছে।
মা ক্ষীণ গলায় বললেন, বাইরের একজন মানুষ!
বাবা বিরক্ত গলায় বললেন, সেতো আর তোমার বিছানায় এসে শুয়ে থাকবে না। সে থাকবে তার মত। উত্তরের দরজাটা পার্মানেন্ট বন্ধ করে দিলেই সে আলাদা হয়ে যাবে। নিজের মত থাকবে। নিজে রান্না করে খাবে।
উত্তরের দরজা আমরা ভেতর থেকে বন্ধ করে স্যারকে থাকতে দিলাম। তিনি তাঁর জিনিসপত্র নিয়ে একদিন দুপুর বেলা দুটা রিকশা করে উপস্থিত।
প্রথম কিছুদিন আমি শঙ্কিত ছিলাম— হয়ত যখন স্যারকে দেখা যাবে আমাদের বসার ঘরে বসে আছেন। হয়ত ছাদে গিয়েছি দেখব জায়নামাজ হাতে তিনিও ছাদে উঠে এসেছেন নামায পড়ার জন্যে। কিংবা কলেজে দেখা হলে তিনি পরিচিত ভঙ্গিতে বলবেন, এই যে নবনী খবর কি? আর ক্লাসের সব ছাত্রী আমাকে ক্ষেপাবে।
বাস্তবে তার কিছুই হল না। স্যার কলেজে যান। কলেজ থেকে ফিরে বাসায় আসেন। আর তার কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। আমাদের বাড়ির একটা অংশে যে একজন মানুষ বাস করে তা মনেই হয় না। শুধু ছাদ থেকে আমি মাঝে মাঝে দেখি তিনি বারান্দায় রান্না চড়িয়েছেন। একদিন তাঁর পোষা কাকটাকে দেখলাম। শুরুতে কাকটা রেলিং-এ বসেছিল। তারপর রেলিং থেকে নেমে গম্ভীর ভঙ্গিতে হেঁটে স্যারের পাশে বসে থাকল। ভাবটা এ রকম যেন সেও রান্নাবান্না তদারক করছে। এরকম মজার দৃশ্য আমি আমার জীবনে আর দেখি নি।