হ্যাঁ।
চল আমরা বের হই। মেলা কাজ। টুকটাক জিনিস কিনব। রাতে আবার দাওয়াত।
দাওয়াত খেতে ইচ্ছা করছে না।
ইচ্ছা না করলেও যেতে হবে। উপায় নেই। আমার বস দাওয়াত দিয়েছে। সফিক। তোমাকেতো আগেই বলেছি আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। তারই এ্যাড ব্যবসা। সফিকের আমার বিয়েতে যাবার কথা ছিল। যেতে পারল না–ব্যাংকক যেতে হল। ও আজ সকালের ফ্লাইটে এসেছে।
তোমার খুব ভাল বন্ধু?
অবশ্যই ভাল বন্ধু। তুই তোকারি সম্পর্ক। আমি যে এত ছোট একটা কাজ করি এটা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। শুধু যে আমার সাথেই এই ব্যবহার তা না, সবার সাথে। অফিসের দারোয়ানের মেয়ের বিয়ে। অফিসের কেউ যায় নি–সফিক গিয়েছিল। তোমাকে নিয়ে এসেছি শুনে তৎক্ষণাৎ সে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চলে আসছিল। তুমি ঘুমোচ্ছ ভেবে আনি নি।
এলে সমস্যাও হত। তাকে বসাতে কোথায়? শোবার ঘর ছাড়া এখানে আর ঘর কোথায়?
শোবার ঘরেই বসতাম। সমস্যা নেই। ও পা মেলে মেঝেতে বসে কতদিন চা খেয়েছে। মানুষ হিসেবেও অসাধারণ। দেখলেই বুঝবে। ফ্লাস্কটা দাও তো নবনী। চা নিয়ে আসি। চা খেয়েই বের হয়ে পড়ি।
ঘরে চা বানানোর ব্যবস্থা নেই?
না। আজ সব কিনব। আমি চা খাই না তো, এই জন্যে ব্যবস্থা রাখি নি। তুমি তো আবার খুব চা খাও।
কে বলল?
বাসররাতে তোমার ছোটখালা চা নিয়ে এলেন, তুমি খুব আরাম করে খেলে— সবটা চা শেষ করলে। সেখান থেকেই বুঝলাম।
ও হাসছে। সুন্দর করে হাসছে। আমার গোপন রহস্য ধরে ফেলেছে, সেই রহস্যভেদের হাসি। আনন্দ ও তৃপ্তির হাসি।
ফ্লাস্ক নিয়ে যাবার পথে ও আবার ময়নাটার সামনে দাঁড়াল। আবার সেই অনুনয়-বিনয়–বল ময়না, বল, বল— নবনী। বল তো দেখি। সুন্দর করে বল— নবনী। ন-ব-নী। কলা খেতে দেব। কলা।
ময়না কথা বলার সেই আশ্চর্য বিদ্যা গোপন করেই রাখল। একবার ডেকে ফেললে কি হয়? বেচারা এত চেষ্টা করছে। কে জানে আমার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই সে হয়ত নবনী ডাক শেখানোর চেষ্টা করছে।
ও ফ্লাস্ক নিয়ে চলে যাবার পরপরই ময়না ডেকে উঠল। অবিকল ওর মত গলায় ডাকল— নবনী! নবনী! আমার সারা গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। শরীর ঝিম ঝিম করতে লাগল। কি অদ্ভুত ব্যাপার!
নোমান গেটের কাছ থেকে আবার ফিরে আসছে। হনাহন করে আসছে। পাখির কথা শুনতে পেয়ে আসছে বলে মনে হয় না। পাখির গলা এতদূর যাবে না। অন্য কিছু হবে। হয়ত মানিব্যাগ ফেলে গেছে।
নবনী!
কি?
তোমার জ্বর-টর আসে নি তো? অফিস থেকে ফিরে তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল জ্বর এসেছে।
না, জ্বর আসে নি। তুমি কি জ্বরের খোেজ নেবার জন্যে ফিরে এসেছ?
হ্যাঁ। দেখি কাছে আস তো। জ্বর আছে কি-না দেখি।
আমি ওর কাছে এগিয়ে এলাম। ও আমার কপালে হাত রাখল। বেচারা আমার শরীর ছুঁয়ে দেখার জন্যে ছুটে এসেছে। জ্বরের মত একটা বাজে অজুহাত তৈরি করেছে। আমার বলতে ইচ্ছা করছে— শোন, তোমার যখনই আমাকে ছয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে, ছয়ে দেখবে। লজ্জা, দ্বিধা বা সঙ্কোচের কোন কারণ নেই। আমি তা বলতে পারলাম না। কিছু কথা আছে যা অতি প্ৰিয়জনদেরও বলা যায় না। তবে ওর এই ছেলেমানুষী কৌশল আমি আমার পরবর্তী জীবনে অনেক অনেকবার কাজে লাগিয়েছি।
যখন আমার নিজের ইচ্ছে করেছে ও আমাকে ছুঁয়ে দেখুক, তখনি বলেছিএই, দেখ তো আমার জ্বর কি-না। শরীরটা ভাল লাগছে না। ও আমার কপালে হাত রেখে বলেছে— গা পানির মত ঠাণ্ডা, জ্বর নেই তো।
আমি হোসে ফেলেছি। ও আমার হাসি দেখে হকচকিয়ে গেছে। তবে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে। বড়দের ছেলেমানুষী এক খেলা।
সফিক সাহেবের বাড়ি
দেখলে কত বড় বাড়ি?
সে এমনভাবে বলল যেন বাড়িটা ওর নিজের। আমি হাসলাম। ওর ছেলেমানুষিগুলো এখন আমার চোখে পড়তে শুরু করেছে। দোকানে কেনাকাটার সময় প্রথম চোখে পড়ল। যা দেখছে তা-ই দাম করছে। জাপানি একটা ডিনার সেট দাম করল। বাহান্ন পিসের সেট— দাম তের হাজার টাকা। সে গম্ভীর গলায় বলল, ফিক্সড প্রাইস? ভাবটা এ-রকম যেন ফিক্স্ড প্রাইস না হলে সে দরদাম করে কিনে ফেলবে। দোকানদাররা মানুষ চেনে। কে কি কিনবে বা কিনবে না তা চট করে ধরে ফেলে। সে জবাব পর্যন্ত দিল না। নোমান তাতে অপমানিত বোধ করল না বা রাগ করল না, পাশের দোকানে ফুলদানি দরদম করতে লাগল। এক একটার দাম দুহাজার টাকা। এমনভাবে দাম করছে যেন দুহাজার টাকা দামের ফুলদানি কয়েকটা কিনবে।
সফিক সাহেবের বাড়িতে ঢোকার পর থেকে সে আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে যে এত সুন্দর বাড়ি এই শহরে আর নেই। বাড়িতে কয়টা ঘর, কয়টা বাথরুম সমানে বলে যাচ্ছে। আমরা বসার ঘরে বসে আছি। ঝাড় বাতি টাতি দিয়ে এই ঘর এমন সাজানো যে এখানে বসে থাকতে ভাল লাগে না। মনে হয়। সিনেমার একটা বাড়িতে বসে আছি। সফিক সাহেবকে খবর পাঠানো হয়েছে। তিনি এখনো নামছেন না। আমরা যেখানে বসে আছি সেখান থেকেই দোতলার সিঁড়ি চলে গেছে। ভদ্রলোক এই সিঁড়ি ধরেই নামবেন। মার্বেল পাথরের সিঁড়ি। এই সিঁড়িতে কোনদিন হয়ত এক কণা ধূলিও পড়ে থাকে না। আমি সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে আছি।
নবনী, বল তো এ বাড়ির বৈশিষ্ট্য কি?
তা তো বটেই, এ ছাড়া কি?
বলতে পারছি না।
এ বাড়ির ছাদে কি আছে বল?
ফুলের বাগান?
বাগান তো আছেই। রোজ গার্ডেন। এ ছাড়া কি আছে বল তোমাকে আগে বলেছিলাম। বাসর রাতে। মনে নেই?
মনে করতে পারছি না।
সুইমিং পুল। বিশাল সুইমিং পুল। বাড়ির ছাদে সুইমিং পুল থাকে কখনো শুনেছ?