ফ্রেম বাধানো নজরুল ইসলামের একটা হাতে আঁকা ছবি আছে। ছবির নিচে লেখা Art by Noman Class VIII, Section B. সাহেব তাহলে ছেলেবেলায় শিল্পী ছিলেন।
খাটের নিচে রাজ্যের জিনিস। তার মধ্যে মাটির পালকি এবং পুতুল আছে। এইগুলি কি জন্যে রাখা কে জানে। জিজ্ঞেস করতে হবে।
আমি হাত-মুখ ধোবার জন্যে বাথরুমে ঢুকলাম। বাথরুমটা ঝকঝকে। আমাদের নেত্রকোনার বাড়ির বাথরুমের মত অন্ধকার এবং স্যাঁতসেঁতে নয়। সবচে বড় কথা-বাথরুমের উপরের দিকে ভেন্টিলেটারের মত আছে, যে ভেন্টিলেটার দিকে আকাশ দেখা যায়। গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে আকাশ দেখার মত আনন্দের আর কি আছে?
মুখে পানি ঢালতেই শরীর জুড়িয়ে গেল। হঠাৎ করে মনে হল আমাদের দুজনের জন্য এরকম একটা ঘরেরই দরকার ছিল।
ও শুধু চা আনেনি, একটা ঠোঙায় কিছু জিলাপী। আরেক ঠোঙায় কিছু নোনতা বিসকিট। সে মিটসেফ থেকে কাপ বের করছে। আমি দেখলাম, দুটা না, সে একটা কাপ বের করেছে। ঐ কাপটি সে এগিয়ে দিল আমার দিকে। নিজে চা ঢালিল ফ্লাস্কের মুখে। যেন আমি খুব সম্মানিত একজন মেহমান। বাইরের কেউ।
নবনী! টি-সেটটা নতুন কিনেছি। সুন্দর না?
হ্যাঁ, খুব সুন্দর।
সেট হিসেবে কিনলে দাম বেশি লাগে। আমি আলাদা আলাদা কিনে সেট বানিয়েছি অনেক সস্তা পড়েছে।
আচ্ছা।
বিকালে তোমাকে নিয়ে বের হতে হবে। টুকটাক অনেক জিনিস কিনতে হবে। তোমার কি কোলবালিশ লাগে?
না।
তোমার জন্য একটা ড্রেসিং টেবিল কিনেছি। এগার তারিখ ডেলিভারি দেয়ার কথা ছিল, নিতে গেলাম, বলে–পালিশ হয় নাই। এখন বোধহয় পালিশ হয়ে গেছে, নিয়ে আসব। আরেকটু চা দেই, ফ্লাস্কে চা আছে। তিন কাপ চা আটে।
আমি ওকে খুশি করার জন্যেই আরেকটু চা নিলাম। শরবতের মত মিষ্টি চা। মুখে দিলেই পেটের নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত মিষ্টি হয়ে যায়।
নবনী শোন, আমি অফিসে যাই। কিছু জরুরি কাজ ছিল। তুমি একা থাকতে পারবে তো?
পারব।
গোসল সেরে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়। তুমি টায়ার্ড হয়ে আছ তোমার ঘুম দরকার।
ও আচ্ছা।
এক-একা ভয় পাবে না তো?
ভয় পাবার কিছু আছে কি?
ভয় পাবার কিছুই নেই। খুব সেইফ জায়গা। অফিসের তিনজন দারোয়ান আছে। এরা সব সময় পাহারা দেয়। আর আমি তো আছিই। আমি মাঝে মাঝে খোঁজ নিয়ে যাব।
খোঁজ নিতে হবে না। আমি ভালই থাকব।
ছোট বাসা দেখে তোমার মন খারাপ হয়নি তো নবনী?
না।
দিন এরকম থাকবে না। নিজেই এক সময় ব্যবসা শুরু করব। এ্যাড ব্যবসার ব্যাপার-স্যাপার। আমি এখন সবই জানি। সাহস করে শুরু করলেই হয়। আরেকটু চা দেই? ফ্রাস্কে আছে খানিকটা।
ও চা ঢেলে দিল। তার মুখ হাসি-হাসি। বারান্দায় ময়নাটার কাছে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে বলল–কথা বল, এই ময়না, কথা বল। বল দেখি– নবনী! নবনী!
ময়না খাঁচার ভেতর ছটফট করছে। কথা বলছে না। আমি খাটে বসে। দেখছি, ও পকেট থেকে কলা বের করে খোসা ছাড়িয়ে সে ময়নাকে দিচ্ছে। গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে প্রায় অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলছে–কথা বল না রে বাবা। বলী–নবনী! নবনী! কি হয় কথা বললে?
আমাকে শুনানোর জন্যেই বেচারার এই চেষ্টা। এই পৃথিবীতে তার যা কিছু দেখানোর আছে সবই সে আমাকে দেখাতে চায়। আমাকে অভিভূত করাই তার व्लझा। ऊाद्ध अgशा७न छिल्ल না।
আমি বললাম, নজরুলের এই ছবি কি তোমার আঁকা? সে লজ্জিত গলায় বলল, হুঁ। ফেলে দেয়া উচিত। ফেলতে পারি না। মায়া লাগে।
ফেলার দরকার কি সুন্দর ছবিতো। এখনো কি ছবি আঁক? না না। কিযে তুমি বল। স্কুলে পড়ার সময় খুব আঁকতাম। নবনী আমি যাই। তাড়াতাড়ি চলে আসব।
সম্পূর্ণ নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। অচেনা ঘরের অচেনা খাটে আমি শুয়ে আছি। ঘরের আলো কমে এসেছে। আবারও মেঘ করেছে। মনে হয়। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। নামুক বৃষ্টি, সব ভাসিয়ে নিয়ে যাক। বৃষ্টি নামলে ময়নাটা ভিজবে। আমি কি ওকে নিয়ে আসব ভেতরে? না-কি ওর পানিতে ভিজে অভ্যাস আছে?
নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন না, একটা পাখির কথা ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। গাঢ় ঘুম। ঘুমের মধ্যেই শুনলাম বৃষ্টি পড়ছে। ঘুমের মধ্যেই পাখিটার ছটফটানি কানে গেল এবং একসময় পাখিটা নবনী নবনী বলে আমাকে ডাকতেও লাগল। এটা হয়ত আমার ভুল। হয়ত আমার স্বপ্নের ক্ষুদ্র অংশ। কিছু কিছু সময়ে মানুষের স্বপ্ন ও সত্য মিলে-মিশে এক হয়ে যায়। পাখিটা আমাকে ক্ৰমাগত ডাকছে— নবনী, নবনী। কি মিষ্টি, কি সুরেলা তার গলা! বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে চারদিক।
আমার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। বৃষ্টি নেই— চারদিক খটখট করছে। পুরোটাই তাহলে স্বপ্ন ছিল? আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। নোমানকে দেখা যাচ্ছেহাতে পলিথিনের দুটা ব্যাগ। ব্যস্ত ভঙ্গিতে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। সে কি অফিস থেকে আবার বাজারে গিয়েছিল?
বারান্দার দরজা খুলে আমি তার জন্যে অপেক্ষা করছি। ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। ও আসুক। ও এলেই বাতি জ্বালাব।
নবনী, খুব দেরি করে ফেললাম। অফিস থেকে বের হতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। নতুন একটা পার্টি এসেছে। কাজ নেই, শুধু বকর বকর করে। অফিস থেকে বের হয়েই একবার উঁকি দিয়েছি। দরজা বন্ধ কয়েকবার ঠিক ঠক করলাম। দরজা খুলল না। বুঝলাম তুমি ঘুমোচ্ছ চলে গেলাম ড্রেসিং টেবিলটার খোঁজে। ওদের সঙ্গেও নানান ঝগড়া।
ঝগড়া কেন?
আর বল কেন? এখনো পালিশ হয় নি। কারিগর না-কি ছুটিতে গেছে। পুরো টাকা অ্যাডভান্স দেয়া, নয়ত অন্যখান থেকে কিনতাম। তোমার ঘুম হয়েছে?