- বইয়ের নামঃ নবনী
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
আজ আমার বিয়ে
দুপুরে গল্পের বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মা এসে গায়ে হাত দিয়ে ঘুম ভাঙালেন। ব্যাকুল গলায় ডাকলেন, নবনী! নবনী!! আমি চোখ মেলতেই তিনি আমার মুখের কাছে মুখ এনে কাতর গলায় বললেন, ওঠ মা। ওঠ!
আমি হকচকিয়ে উঠে বসলাম। মা এভাবে আমাকে ডাকছেন কেন? কিছু কি হয়েছে? বাবা ভাল আছে তো? খাট থেকে নামতে গেছি, মা হাত ধরে আমাকে নামালেন। যেন আমি বাচ্চা একটা মেয়ে। একা একা খাট থেকে নামতে পারি না। আমি বললাম, কি হয়েছে মা?
মা জবাব দিলেন না, অস্পষ্টভাবে হাসলেন। বারান্দায় এসে দেখি, বাবা ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন। তাঁর গায়ে ইন্ত্রি করা পাঞ্জাবি। চুল আঁচড়ানো। আজ দুপুরেও গাল ভর্তি খোচা খোচা কাঁচা-পাকা দাড়ি ছিল। এখন নেই, গাল মসৃণ, শান্ত পরিচ্ছন্ন একজন মানুষ! খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। মাস দুই হল তিনি শয্যাশায়ী। ডান পা অবশ হয়ে আছে। দেয়াল ধরে হাঁটাহাঁটি করেন। তবে বেশির ভাগ সময় খবরের কাগজ হাতে নিয়ে শুয়ে থাকেন নিজের ঘরে। কাগজ পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কঠিন এবং তিক্ত গলায় এ বাড়ির সবার সঙ্গে ঝগড়া করেন। যেন তাঁর এই অসুখের জন্যে আমরাই দায়ী। আজ কি হাসি-খুশি লাগছে বাবাকে। আমার দিকে চোখ পড়তেই তিনি বললেন, দুপুরে ঘুম তো খুব খারাপ অভ্যাস রে মা। ব্যাড হেভিট। হাত-মুখ ধুয়ে আয় আমার কাছে।
আমি হাত-মুখ ধুতে রওনা হলাম। বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে। বড় ধরনের কিছু। পুরো বাড়িটা বদলে গেছে। নিশ্চয়ই আনন্দময় কোন ঘটনা ঘটে গেছে। বাবার সুখী সুখী গলা আবার শুনলাম, ওগো, আমাকে আর নবনীকে চা দাও। বাপ-বেটিতে একসঙ্গে চা খাই। এত সুন্দর করে বাবা অনেক দিন কথা বলেন নি।
বাবা আজ আমার সঙ্গে চা খেতে চাচ্ছে কেন? আমার শরীর ঝিম ঝিম করছে।
আমি চাপা উত্তেজনা নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম।
আমাদের বাথরুম সব সময় অন্ধকার। দুপুরবেলায়ও বাতি না জ্বালালে আয়নায় মুখ দেখা যায় না। আশ্চর্য! আমি সুইচটা খুঁজে পাচ্ছি না। আমার বুক ধ্বক ধ্বক করছে। তীব্ৰ এক অজানা ভয়ে মন অভিভূত হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলাবার জন্যে আমি দরজায় হাত রাখলাম, আর তখন ইরা বাথরুমে ঢুকে বাতি জ্বালাল। ইরার হাতে সাবান, তোয়ালে। সাবানটা নতুন, এখনো মোড়ক খোলা হয় নি।
আমি বললাম, কি হয়েছে। ইরা?
ইরা হাসতে হাসতে বলল, তোমার এত বুদ্ধি, তুমি এখনো বুঝতে পারছি না?
না। বুঝতে পারছি না।
অনুমান করতে পারছি?
ইরা ঝলমলে গলায় বলল, আজ তোমার বিয়ে। রাত দশটার ট্রেনে বর আসবে। রাতেই বিয়ে হবে। কোন উৎসব-টুৎসব কিছু হবে না। তোমাকে নিয়ে তারা ঢাকা চলে যাবে সকালের ট্রেনে।
আমি একদৃষ্টিতে ইরাকে দেখছি। সে আজ তার সেই প্রিয় শাড়িটা পরেছে। সাদা রঙের শিফন শাড়ি। মা তাকে কখনো এই শাড়ি পরতে দেন না। এই শাড়িতে তাকে না-কি বিধবার মত লাগে। কিন্তু আমি আর ইরা শুধু জানি এই শাড়িতে তাকে কত সুন্দর লাগে। ও বোধহয় ক্রমাগতাই কাঁদছে। ওর মুখ শুকনো। চোখ ভেজা। সে হাসতে হাসতে কথা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না।
ইরা বলল, সবাই খুব খুশি। সবচে খুশি বাবা। আপা, তুমি মুখটা নিচু কর, আমি সাবান দিয়ে তোমার মুখ ধুইয়ে দেই।
তোর মুখ ধুইয়ে দিতে হবে না। তুই যা।
ইরা বলল, আপা শোন— বাবা যে সবচে খুশি তা না। সবচে খুশি হয়েছি আমি। খবরটা শোনার পর থেকে আমি আনন্দে শুধু কাঁদছি।
তুই এখন যা। আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি।
ইরা পুরোপুরি চলে গেল না। বাথরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। আমি তোকালাম আয়নার দিকে। আয়নায় কি সুন্দর দেখাচ্ছে আমাকে! শান্ত সরল চেহারার একটা মেয়ের মুখ। আয়নার মুখ কখনো হাত দিয়ে ছোয়া যায় না। আমার প্রায়ই আয়নার মুখটাকে ছুঁতে ইচ্ছা করে। আজও করছে। আমি হাত দিয়ে সেই মুখ ছুঁতে গিয়ে আয়নায় সাবানের ফেনা লাগিয়ে ফেললাম।
আজ আমার বিয়ে।
আমার কেমন লাগছে?
এখনো বুঝতে পারছি না। আমার সমস্ত বোধ অসাড় হয়ে আছে। তবে এক ধরনের শান্তি বোধ করেছি। আমার একটা সমস্যা ছিল, ভয়াবহ ধরনের সমস্যা আজ হয়তো তা মিটে যাবে–এই শান্তি। বাথরুম থেকে বের হয়ে আমি সবার খুশি মুখ দেখব। এ-ও তো কম না।
আমার বিয়ে নিয়ে সবাই খুব সমস্যার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। সবাই ধরেই নিয়েছিল, আমার কোনদিন বিয়ে হবে না। এমন কোন দোয়া নেই। যা মা আমার জন্যে পড়েন নি। আজমীর শরীফ থেকে আনা লাল সুতা এখনো আমার গলায় ঝুলছে। বিয়ে হয়ে যাবার পর এই সুতা খুলে ফেলতে হয়। যদি সত্যি সত্যি বিয়ে হয় তাহলে নিশ্চয় বাসর ঘরে ঢোকার আগে ইরা এসে কাঁচি দিয়ে সুতা কাটবে। সুতা কাটতে গিয়ে হয়ত সে কিছুক্ষণ কাঁদবে। ইরা খুব কাঁদতে পারে।
সত্যি কি আজ বিয়ে হবে? কেন জানি এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। স্বপ্ন দেখছি না তো? গল্পের বই পড়তে পড়তে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হয়ত ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখছি। বিয়ের স্বপ্ন আমি প্রায়ই দেখি। স্বপ্নের মধ্যেই একটা ঝামেলা হয়ে বিয়ে ভেঙে যায়। আমি দেখি একটা সুন্দর ছেলে আমার পাশে বসা। এক সময় সে উঠে চলে যায়। আমি চোখ ভর্তি জল নিয়ে জেগে উঠে খুব লজ্জিত হই। বাস্তব কখনো স্বপ্নের মত নয়। বাস্তব অন্যরকম। বাস্তবে অনেক কথাবাতাঁর পর বিয়ে ঠিক হয়। আলাপ আলোচনা একটা পৰ্যায় পর্যন্ত যায়, তারপর তারা সুন্দর একটি চিঠি রেজিস্ট্রি করে পাঠায়–