রাধানাথ ভ্রু কুঁচকে বসে আছেন। আজ আর চিলেকোঠার প্রার্থনাঘরে যাওয়া হবে না। ঈশ্বরের অস্তিত্ববিষয়ে সন্দেহজনক কোনো চিন্তা মাথায় এলে তিনি অস্থির বোধ করেন। সেদিন আর তার প্রার্থনাঘরে যাওয়া হয় না। এক-দু’দিন সময় লাগে মন ঠিক করতে। মন ঠিক হওয়ার পর জীবনযাপন স্বাভাবিক হয়ে আসে।
দরজা খুলে প্রেসের পিয়ন মাথা বের করল। তার চোখে ভয়। সাধুবাবার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন পড়লে সে কোনো কারণ ছাড়াই ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ে।
কিছু বলবি ফণি?
বাবু, চা দিব?
না।
আপনার কি শরীর খারাপ?
না।
আপনার কাছে একজন ভদ্রলোক আসছে। এক ঘণ্টার উপরে হইল বইসা আছেন। আপনার সঙ্গে নাকি বিশেষ প্রয়োজন। আমি কী বলব, আপনি ঘুমে আছেন?
আমি তো ঘুমাচ্ছি না। মিথ্যা বলবি কেন? ঘরে বাতি জ্বালা। ভদ্রলোককে এখানে নিয়ে আয়।
বাবু, আপনাকে কি লেবুর শরবত বানায়ে দিব?
আচ্ছা দে।
ভদ্রলোকের পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। পায়ে চপ্পল। অত্যন্ত সুপুরুষ। এই সন্ধ্যাবেলাতেও তাঁর চোখে কালো চশমা। রাধানাথের বিছানার কাছে রাখা কাঠের চেয়ারে তিনি মোটামুটি শক্ত হয়ে বসে আছেন। চেয়ারের হাতলে হাত রাখা, সেই হাতও শক্ত। রাধানাথ বললেন, আমার কাছে কী প্রয়োজন?
ভদ্রলোক ইতস্তত করে বললেন, শুনেছি আপনি খুব ভালো হাত দেখেন। আমি আপনাকে হাত দেখাতে এসেছি।
রাধানাথ বললেন, আমি নিজের শখে মাঝে মধ্যে হাত দেখি। অন্যের শখে দেখি না।
ভদ্রলোক ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। রাধানাথ বললেন, হাত দেখার এই অপবিজ্ঞানে আমার কোনো আস্থা নেই। দুর্বল মানুষ এর পেছনে ছোটে। আপনি দুর্বল হবেন কেন?
ভদ্রলোক বললেন, আমি আপনার জন্যে সামান্য কিছু উপহার এনেছি। দার্জিলিংয়ের চায়ের দুটা প্যাকেট। আপনি উপহার গ্রহণ করলে আমি খুশি হব।
রাধানাথ বললেন, আমি উপহার গ্রহণ করলাম, কিন্তু আপনার হাত দেখব। প্রেসে ফণি বলে এক কর্মচারী আছে, তার কাছে চায়ের প্যাকেট দিয়ে যান।
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। বিনীত গলায় বললেন, স্যার, তাহলে যাই। আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে লজ্জিত।
রাধানাথ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, বসুন। দু’হাত মেলুন। তার আগে আমার টেবিলের ড্রয়ারে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস আছে, সেটা আমাকে দিন। সন্ধ্যাবেলা কেউ আমার কাছ থেকে মন খারাপ করে চলে যাবে তা হবে না। সন্ধ্যা হলো বিশ্বপিতার মাহেন্দ্রক্ষণ।
স্যার, আপনাকে ধন্যবাদ।
ছাদ থেকে ঝুলন্ত চল্লিশ ওয়াট বাল্বের আলো রাধানাথের জন্যে যথেষ্ট না। রাধানাথ ম্যাগনিফাইং গ্লাস হাতে ঝুঁকে আছেন। তাঁর চোখও সমস্যা করছে। রুমালে বারবার চোখ মুছতে হচ্ছে।
আপনার নাম কী?
ভদ্রলোক নড়েচড়ে বসলেন। জবাব দিলেন না। রাধানাথ বললেন, নাম বলতে কি সমস্যা আছে? সমস্যা থাকলে বলতে হবে না। নামে কিছু আসে যায়। আসে যায় কর্মে। যিশুখ্রিষ্টকে বিশুব্রিষ্ট ডাকলেও তার যিশুত্ব কিছুমাত্র কমবে।
আমার নাম ফরিদ।
রাধানাথ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আসল নাম গোপন করলেন, তাই না? ফরিদ নামেও চলবে। আপনি সেনাবাহিনীতে আছেন? আপনার হাভভাব, চোখের কালো চশমায় এরকম মনে হচ্ছে। আপনি সেনাবাহিনীতে আছেন এমন তথ্য হাতে লেখা নেই। অনুমানে বললাম।
আমি সেনাবাহিনীতে ছিলাম, এখন নেই।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন?
হুঁ।
খেতাবধারী?
হুঁ।
কতক্ষণ আর হুঁ হুঁ করবেন? দু’-একটা কথা বলুন শুনি। কী খেতাব পেয়েছেন? হাত দেখে মনে হচ্ছে বড় খেতাব। বীরউত্তম নাকি?
আপনার অপঘাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রবল। ফাঁসিতে মৃত্যু। বিশেষ আর কিছু জানতে চাইলে কুষ্ঠি তৈরি করতে হবে। চা খাবেন?
না।
আপনি সাহসী, একরোখা, জেদি এবং নির্বোধ। আপনার সুবিধা হচ্ছে, নিজের নির্বুদ্ধিতার বিষয়ে আপনি জানেন, অন্যরা জানে না। যদি সম্ভব হয় একটা রত্ন ধারণ করবেন। রত্নের নাম গোমেদ, ইংরেজিতে বলে গার্নেট। দশ রতির মতো হলেই চলবে।
আপনার এখানে পাওয়া যায়?
না। আমি রত্নব্যবসা করি না।
রত্ন কোথায় পাওয়া যাবে?
ঢাকায় পাবেন না। কলকাতা থেকে সগ্রহ করলে ভালো হয়।
রাধানাথের চোখের যন্ত্রণা হঠাৎ অনেকখানি বাড়ল। তিনি রুমালে চোখ ঢাকতে ঢাকতে বললেন, আপনি কি বিশেষ কিছু জানতে চান?
যুবক ইতস্তত করে বললেন, মানুষের ভাগ্য কি পূর্বনির্ধারিত?
রাধানাথ বললেন, এই জটিল প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আপনাদের ধর্মগ্রন্থ অনুসারে পূর্বনির্ধারিত। সূরা বনি ইসরাইলে আল্লাহ বলছেন, আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় নেকলেসের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। ইহা আমার পক্ষে সম্ভব।
আপনি কোরানশরিফ পড়েছেন?
অনুবাদ পড়েছি।
আগন্তুক বলল, আপনার দেয়ালে অতি মূল্যবান কিছু ছবি দেখতে পাচ্ছি।
রাধানাথ বললেন, এই পৃথিবীতে মূল্যবান শুধু মানুষের জীবন, আর সবই মূল্যহীন।
আগন্তুক দার্শনিক কথাবার্তার দিকে না গিয়ে বলল, ছবিগুলি অযত্নে আছে। ধুলা মাকড়শার ঝুল। আমি কি আপনার প্রেসের ছেলে ফণিকে বলে ঠিক করে দিয়ে যাব?
না।
আপনার কাছে নাম গোপন করেছিলাম বলে দুঃখিত। আমার নাম শরিফুল হক। আচ্ছা জনাব, যাই।
ডাকনাম ডালিম?
আমাকে ডালিম নামেই বেশির ভাগ চেনে।
আপনি তাহলে ডালিম কুমার?
যুবক জবাব দিলেন না। রাধানাথ কোনো কারণ ছাড়াই খানিকটা অস্থির বোধ করলেন। যুবক কি তার নিজের অস্থিরতা খানিকটা তাকে দিয়েছে। এই সম্ভাবনা আছে। মানুষ চুম্বকের মতো। একটি চুম্বক যেমন পাশের চুম্বককে প্রভাবিত করে, মানুষও করে।