শফিক বলল, আগে কি হেডলাইনগুলি পড়ব?
রাধানাথ বললেন, পত্রিকায় সবচেয়ে ভালো খবর আজ কী ছাপা হয়েছে সেটা পড়ো। এরপর পড়বে সবচেয়ে খারাপ খবর। ভালো ও মন্দে কাটাকাটি হয়ে যাবে।
শফিক বলল, ভালো খবর তেমন কিছু পাচ্ছি না। রাধানাথ বললেন, একটা জাতীয় দৈনিকে ভালো কোনো খবর ছাপা হবে না তা হয় না। ভালোমতো খুঁজে দেখো, নিশ্চয়ই কিছু-না-কিছু আছে। রিকশাওয়ালার সততা, মানিব্যাগ কুড়িয়ে পেয়ে ফেরত দিয়েছে টাইপ কিছু থাকার কথা।
শফিক বলল, একটা পেয়েছি। লবণের দাম কিছু কমেছে। আগে ছিল ষাট টাকা কেজি, এখন হয়েছে পঞ্চাশ টাকা কেজি। সরকার স্থলপথে ইন্ডিয়া থেকে লবণ আমদানির নির্দেশ দিয়েছেন।
রাধানাথ বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি তো খুবই খারাপ একটা খবর পড়লে। কক্সবাজার ভর্তি সামুদ্রিক লবণ। অথচ লবণ আনতে হচ্ছে ইন্ডিয়া থেকে। হোয়াট এ শেম! এখন ভালো খবরটা পড়ো।
শফিক বলল, দুটা এক শ’ টাকার নোটের ছবি পাশাপাশি ছাপা হয়েছে। নোট দুটার নম্বর এক খবরে বলেছে, বাংলাদেশের কারেন্সি ইন্ডিয়া ছেপে দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, তারা দুই সেট কারেন্সি ছাপে। এক সেট বাংলাদেশকে দেয়, অন্য সেট তারা বাংলাদেশি পণ্য নেওয়ার জন্য ব্যবহার করে।
রাধানাথ বললেন, এটা তো খুবই ভালো খবর।
ভালো খবর?
অবশ্যই ভালো খবর। বাংলাদেশ সরকার গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে। ইন্ডিয়ার প্রতি নির্ভরতা কমাবে।
শফিক বলল, আপনার যুক্তি অদ্ভুত, কিন্তু ভালো।
রাধানাথ বললেন, যুক্তিবিদ্যা অতি দুর্বল বিদ্যা, সবদিকে এই বিদ্যা খাটানো যায়। যাই হোক, তুমি চলে যাও, আজ আমি ডিকটেশন দেব না।
আপনার কি শরীর খারাপ?
হুঁ। চোখের যন্ত্রণা বাড়ছে। মনে হয় অন্ধ হওয়ার পথে এগুচ্ছি। এটা ভালো। কীভাবে ভালো?
জগতের রূপ দেখতে হয় চোখ বন্ধ করে। হাছন রাজা তাই বলেছেন, “আঁখি মুঞ্জিয়া দেখো রূপ রে।” জগতের রূপ দেখার জন্য তৈরি হচ্ছি, খারাপ কী? ড্রয়ারটা খোলো।
শফিক ড্রয়ার খুলল।
রাধানাথ ক্লান্ত গলায় বলল, তোমার চল্লিশ টাকা পাওনা হয়েছে। পঞ্চাশ টাকার নোটটা নিয়ে যাও। দশ টাকা পরে ফেরত দিয়ে। টিসিবির একটা রসিদ আছে দেখো। রসিদে হয় শার্টের জন্য আড়াই গজ কাপড় দিবে, নয়তো প্যান্টপিস দেবে। রসিদ দেখিয়ে তোমার যেটা প্রয়োজন নিয়ে নিয়ে। এখন বলো, মানুষের সবচেয়ে কঠিন অভাব কোনটা?
খাদ্যের অভাব।
হয় নাই। বস্ত্রের অভাব। ক্ষুধার্ত অবস্থায় তুমি পথে বের হতে পারবে। ভিক্ষা চাইতে পারবে। নগ্ন অবস্থায় সেটা পারবে না। তোমাকে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতে হবে।
শফিক বলল, আপনার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
রাধানাথ বললেন, দেখে কি মনে হচ্ছে না গভীর দুঃখে আমি কাঁদছি?
মনে হচ্ছে।
রাধানাথ আগ্রহের সঙ্গে বললেন, ধর্মপাশার একজন সাধুর নাম ‘অশ্রুবাবা’। তিনি ভক্তদের দেখলেই চোখের জল ফেলতেন। অশ্রুবাবার নামডাক শুনে একবার তাকে দেখতে গেলাম। তিনি দু’হাতে আমার ডানহাত জড়িয়ে ধরলেন। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। আমি আবিষ্কার করলাম, তার চোখের কোনো সমস্যার কারণে তিনি অশ্রুবর্ষণ করেন। ভক্তের দুঃখে আপুত হয়ে বা তার প্রতি মমতাবশত অশ্রুবর্ষণ করেন না। তার হাতটা আমার দেখার শখ ছিল। আমি বললাম, বাবা, আপনার হাতটা একটু দেখি। আমি একজন শখের হস্তরেখাবিদ। তিনি সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত মুঠো করে চোখমুখ শক্ত করে ফেললেন। অশ্রুবাবা এরকম কেন করলেন জানো?
না।
তিনি নিশ্চয়ই বড় কোনো পাপ করেছেন। তার ধারণা হয়েছিল আমি হাত দেখে সেটা ধরে ফেলব।
শফিক বলল, আপনি আমার হাতটা একদিন দেখে দেবেন না।
রাধানাথ বললেন, না। হাতের রেখায় মানুষের ভাগ্য থাকে না। মানুষের ভাগ্য থাকে কর্মে। তোমার কর্ম তো আমি দেখছি।
শফিক বলল, হাতের রেখা বিশ্বাস করেন না, তাহলে হাত দেখেন কেন?
রাধানাথ বললেন, পাঁচ হাজার বছর ধরে মানুষ ভুলের পেছনে কেন ছুটছে, কেন এই বিদ্যার চর্চা এখনো হচ্ছে, তা জানার জন্যে। এখন তুমি বিদায় হও। আজ একদিনে অনেক কথা বলে ফেলেছি। আজকের কথা বলার কোটা শেষ। আজ আর কথা বলব না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকব।
‘অতিভুক্তিরতী বোক্রিঃ
সদ্যঃপ্রাণাপহারিণী’
এর অর্থ—অতিরিক্ত ভোজন এবং অতিরিক্ত বাচালতা সদ্য প্রাণনাশক।
রাধানাথ বাবু দরজা-জানালা বন্ধ করে ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়লেন। তিনি চিলেকোঠায় মেঝেতে পাতা শীতলপাটিতে ঘুমান। এই ঘরে কখনো না। এটা অতিথি-অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার ঘর। দেয়ালে যামিনী রায়ের দুটি দুর্লভ ছবি আছে। দুই ছবির মাঝখানে রামকিংকর বেইজের ড্রয়িং। ছবিগুলি যত্নে আছে তা না। যামিনী রায়ের হুক খুলে গেছে বলে তিনি ফাঁস নেওয়ার মতো দেয়ালে ঝুলছেন।
রাধানাথ সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমালেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলেন, তাকে একটা প্রকাণ্ড কাঁঠালগাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। গাছভর্তি বিষপিঁপড়া। অর্ধেকটা লাল অর্ধেকটা কালো। বিষপিঁপড়ারা তাঁকে কামড়াচ্ছে। হাত-পা বাঁধা বলে তিনি গা থেকে পিঁপড়া তাড়াতে পারছেন না। আশপাশে কেউ নেই যে তিনি সাহায্যের জন্যে ডাকবেন।
এই স্বপ্নটা তিনি এর আগেও কয়েকবার দেখেছেন। প্রতিবার স্বপ্নেই কিছু পার্থক্য থাকে, কিন্তু মূল বিষয় এক। তিনি গাছের সঙ্গে বাঁধা। পিঁপড়া তাঁকে কামড়াচ্ছে। এই স্বপ্নের কোনো ব্যাখ্যা কি আছে? কেউ তাকে কোনো বিষয়ে সাবধান করে দিতে চাচ্ছে? সেই কেউটা কে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদি পিতা? সেই আদি পিতাকে কে সৃষ্টি করেছে? তিনি স্বয়ম্ভু। নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন। সেটা কী করে সম্ভব!