জোবেদা বলল, মানুষটা ভূতের ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। কাঠের ব্রিজ পার হতে পারছে না।
ভূত বলে কিছু নেই মা। ভূত গ্রামের দুর্বল মানুষের কল্পনা। মাথা নেই একটা ভূত কাঠের পুলে বসে থাকে। নিশিরাতে কেউ পুল পার হতে গেলে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। এইসব হলো গল্প।
জোবেদা বললেন, বাবারে! কয়েকজন তো মারা গেছে।
কয়েকজন না, দুজন মারা গেছে। তারা পা পিছলে খালে পড়ে মরেছে। আমি নিশিরাতে অনেকবার পুল পার হয়েছি। আমি মাথাকাটা ভূত দেখি নাই।
ভূত-প্রেত সবার কাছে যায় না। কারও কারও কাছে যায়।
মা! ঘুমাও তো।
শফিক কাথার নিচে ঢুকে বাক্যালাপের ইতি করল। সেই রাতে তার ভালো ঘুম হলো। ঘুম ভাঙল লোকজনের হইচই চিকারের শব্দে। তার বাবার মৃতদেহ কাঠের পুলের নিচে পাওয়া গেছে। তার হাতে চটের ব্যাগ। ব্যাগে একটা শাড়ি। নিশ্চয়ই তার স্ত্রীর জন্যে কেনা। আর একটা হারমোনিকা।
হারমোনিকা তিনি কেন কিনেছিলেন, কার জন্যে কিনেছিলেন, এই রহস্য ভেদ হয় নি। শফিকের বাবা হারমোনিকা কেনার মানুষ না। তিনি মাওলানা মানুষ।
কিছু রহস্য মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। সেইসব রহস্যের কখনোই কোনো কিনারা হয় না।
হারমোনিকা শফিকের কাছে আছে। কখনো এই বাদ্যযন্ত্রে ফু দেওয়া হয় নি। শফিক ঠিক করে রেখেছে তার জীবনে যদি কখনো গাঢ় আনন্দের ব্যাপার ঘটে, তাহলে সে হারমোনিকায় ফুঁ দেবে।
রাত অনেক হয়েছে। অবন্তি ঘুমাতে গেছে। রহিমা, অবন্তির ঘরে মেঝেতে বিছানা করেছে। অবন্তি একা ঘুমাতে চায়, সরফরাজ খানের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
রহিমার নানান সমস্যা আছে। সে ঘুমের মধ্যে কথা বলে, হঠাৎ হঠাৎ বিকট শব্দে তার নাক ডাকে। তারচেয়েও বড় সমস্যা হলো, মাঝে মাঝে রহিমা জেগে বসে থাকে। তাকে দেখে তখন মনে হয় সে কাউকে চিনতে পারছে না। এই সময় সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
রহিমা বলল, পান খাইবেন আফা?
অবন্তি বলল, না।
রহিমা বলল, জর্দা দিয়া পান খাইলে মেয়েছেলের শইলে সুঘ্রাণ হয়।
অবন্তি বলল, জর্দা খেয়ে শরীরে সুঘ্রাণ করার কিছু নাই। গায়ে পারফিউম দিলেই হয়।
রহিমা হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি খোয়াবে একটা জিনিস পাইছি, বলব?
না। কথা বলাবলি বন্ধ। এখন ঘুম।
রহিমা বলল, খোয়বে পাইছি মাস্টার সাবের সাথে আপনার শাদি হবে।
অবন্তি কঠিন গলায় বলল, আমি আর একটা কথাও শুনব না।
রহিমা বলল, আমি নিজের মনে কথা বলি। শুনলে শুনবেন, না শুনলে নাই। আপনার আর মাস্টার সাবের বিবাহ হবে গোপনে। আপনার দাদাজানের অমতে। মামলা মোকদ্দমা হবে। শেষমেষ মিটমাট হবে। আমি খোয়বে পাইছি। আমার খোয়ব বড়ই কঠিন। একবার কী হইছে শুনেন, খোয়বে পাইলাম…
রহিমা কথা বলেই যাচ্ছে।
অবন্তি দুই হাতে কান চেপে ধরে মনে মনে গান করছে-‘আমার এই হেসে যাওয়াতেই আনন্দ খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে সুমন্দ।
মনে মনে গান করলে বাইরের কোনো শব্দ কানে ঢোকে না। এই আবিষ্কার অবন্তির নিজের।
রাধানাথ বাবুর বয়স পঁয়ষট্টি
রাধানাথ বাবুর বয়স পঁয়ষট্টি। তার মাথাভর্তি ধবধবে সাদা চুলের দিকে তাকালেই শুধু বয়স বোঝা যায়। চুলে কলপ করা হলে বয়স ত্রিশের কোঠায় নেমে আসত। সবল সুঠাম বেঁটেখাটো মানুষ। চোখ বড় বড় বলে মনে হয় তিনি সারাক্ষণ বিস্মিত হয়ে আছেন। তাঁর গাত্রবর্ণ অস্বাভাবিক গৌর। তার মাসি বলতেন, আমার রাধুর গা থেকে আলো বের হয়। রাতেরবেলা এই আলোতে তুলসি দাসের রামায়ণ পড়া যায়।
চিরকুমার এই মানুষটি নীলক্ষেতের একটা দোতলা বাড়ির চিলেকোঠায় থাকেন। একতলায় তাঁর প্রেস। প্রেসের নাম ‘আদর্শলিপি’ প্রেসের সঙ্গে জিংক ব্লকের একটা ছোট্ট কারখানাও আছে। প্রেসের লোকজন তাকে ডাকেন সাধুবাবা। সাধুবাবা ডাকার যৌক্তিক কারণ আছে। তাঁর আচার-আচরণ, জীবনযাপন সাধুসন্তদের মতো।
বাড়ির চিলেকোঠায় তাঁর প্রার্থনার ব্যবস্থা। পশমের আসনে বসে চোখ বন্ধ করে তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রার্থনায় বসেন। তাঁর সামনে থাকে ভুষাকালির একটা বাঁধানো পায়ের ছাপ। এই পায়ের ছাপে বুড়ো আঙুল নেই। এই ছাপটা কার পায়ের তা তিনি কাউকে এখনো বলেন নি। প্রার্থনার সময় পায়ের ছাপের সামনে রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলে। ধূপ পোড়ানো হয়। কোনো কোনো দিন প্রার্থনা দ্রুত শেষ হয়, আবার দীর্ঘসময় নিয়েও প্রার্থনা চলে। সারা রাত প্রার্থনা চলেছে এমন নজিরও আছে।
সাধুবাবা রাধানাথ শুচিবায়ুগ্রস্ত। কিন্তু তিনি মানুষের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলেন। তার পরিচিত সবাই বিষয়টি জানে। খুব সাবধানে থাকে। দৈবাৎ কারও গায়ের সঙ্গে গা লেগে গেলে তিনি তৎক্ষণাৎ স্নান করেন। স্নানের পর ভেজা কাপড় বদলান না। ভেজা কাপড় গায়ে শুকান।
তিনি নিরামিষাশি এবং একাহারি। সূর্য ডোবার আগে আগে খাবার খান, তবে সারা দিনই ঘনঘন চা খান, লেবুর শরবত খান। বেদানা তার প্রিয় ফল। পাথরের বাটিতে সব সময়ই দানা ছড়ানো বেদানা থাকে।
রাধানাথ বাবুর সামনে দৈনিক ইত্তেফাক হাতে শফিক বসে আছে। সে এই বাড়িতে প্রতিদিন সকাল ন’টার মধ্যে এসে পড়ে। তার দুটি দায়িত্বের একটি রাধানাথ বাবুকে খবরের কাগজ পড়ে শোনানো এবং অন্যটি হলো তাঁর ডিকটেশন নেওয়া। কিছুদিন হলো রাধানাথ বাবুর চোখের সমস্যা হচ্ছে। পড়তে গেলে বা লিখতে গেলে চোখ কড়কড় করে। চোখ দিয়ে পানি পড়ে। তিনি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। ডাক্তার বলেছে চোখের পাতায় খুশকি হয়েছে। চিরকাল তিনি জেনেছেন খুশকি মাথায় হয়। খুশকি যে চোখের পাতায়ও হয় তা তার জানা ছিল। জগতের কতকিছুই যে জানেন না তা ভেবে সেদিন তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন।