কালাপাহাড় আরেকবার ঘেউ করে শুয়ে পড়ল। তার ডিনার শেষ হয়েছে। ঝড়বৃষ্টির রাতে সে আর বের হবে না। এখানেই থাকবে। একজন প্রভু পাওয়া গেছে, এই আনন্দেও সে মনে হয় খানিকটা আনন্দিত। মানুষ এবং পশু শুধু যে বন্ধু খোঁজে তা না, তারা প্রভুও খোঁজে।
অবন্তি মায়ের চিঠি নিয়ে শুয়েছে। খাম খুলেই সে প্রথমে গন্ধ শুকল। তার মা চিঠিতে দু’ ফোঁটা পারফিউম দিয়ে খাম বন্ধ করেন। গন্ধের খানিকটা থেকে যায়।
আজকের গন্ধটা অদ্ভুত। চা-পাতা চা-পাতা গন্ধ। মা’র কাছ থেকে এই পারফিউমের নাম জানতে হবে। অবন্তি চিঠি পড়তে শুরু করল–
শুভ জন্মদিন অবন্তি মা,
তুমি তোমার যে ছবি পাঠিয়েছ, এই মুহূর্তে তা আমার লেখার টেবিলে। আমি প্রবল ঈর্ষা নিয়ে ছবিটির দিকে তাকাতে তাকাতে তোমাকে লিখছি। তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর হয়ে পৃথিবীতে এসেছ। তোমার মতো বয়সে সবাই আমাকে ডাকত ‘Flower’। তোমার নাম আমি দিলাম ‘স্বর্গের পুষ্প’। একটাই ক্রটি–তোমার চোখ আমার চোখের মতো নীল হয় নি। তুমি তোমার বাবার কালো চোখ পেয়েছ। ভালো কথা, তোমার বাবার সঙ্গে কি তোমার কোনো যোগাযোগ হয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, মানুষটা কি শেষ পর্যন্ত হারিয়েই গেল?
তুমি চিঠিতে তোমার এক গৃহশিক্ষকের কথা লিখেছ। তুমি কি এই যুবকের প্রেমে পড়েছ? চট করে কারও প্রেমে পড়ে যাওয়া কোনো কাজের কথা না। অতি রূপবতীদের কারও প্রেমে পড়তে নেই। অন্যেরা তাদের প্রেমে পড়বে, তা-ই নিয়ম।
এখন আমি তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাচ্ছি। তুমি কি আসবে আমার এখানে?
যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি হতদরিদ্র দেশে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না। তোমার বৃদ্ধ দাদাজানকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে দেশে পড়ে থাকতে হবে—এটা কোনো কাজের কথা না। তোমার জীবন তোমার একারই। এক বৃদ্ধকে সেখানে জড়ানোর কিছু নেই। সে বরং একটা কমবয়সী মেয়ে বিয়ে করুক। একজন বৃদ্ধের সঙ্গে তোমার বাস করাকেও আমি ভালো চোখে দেখছি না। সেক্স-ডিজাইভড় বৃদ্ধরা নানান কুকাণ্ড করে। আমি তোমাকে নিয়ে চিন্তায় আছি।
লুইসের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আমি একা বাস করছি। লুইসের কারণে আমি অনেক টাকার মালিক হয়েছি। ঠিক করেছি সমুদ্রের কাছে একটা ভিলা কিনে বাস করব। তুমি আমার সঙ্গে এসে থাকতে পারো। মা-মেয়ে সুখে জীবন পার করে দেব।
তোমার জন্মদিন উপলক্ষে পারফিউমের একটা সেট পাঠালাম। তোমার ষোল বছর হয়েছে বলে যোলটা পারফিউম। এর মধ্যে তোমার কাছে সবচেয়ে ভাললাটার নাম আমাকে লিখে পাঠাবে। যদি আমার পছন্দের সঙ্গে মিলে যায় তাহলে পুরস্কার আছে।
মা, তুমি ভালো থেকো। প্রায়ই তোমাকে নিয়ে আমি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখি, আমার অস্থির লাগে।
ইসাবেলা
মেঘ কেটে আকাশে চাঁদ উঠেছে। ভাদ্র মাসে চাঁদের আলো সবচেয়ে প্রবল হয়। চারদিকে পানি জমে থাকে বলে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে ভাদ্রের চন্দ্র-রাত আলোময় হয়।
শফিক বারান্দায় কাঠের বেঞ্চে বসে আছে। বৃষ্টিভেজা উঠান চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। এই রূপ শফিককে স্পর্শ করছে এরকম মনে হচ্ছে না। সে ক্ষুধায় অস্থির। ক্ষুধার সময় দেবতা সামনে এসে দাঁড়ালে তাঁকেও নাকি খাদ্যদ্রব্য মনে হয়।
কালো কুকুরটা এখনো আছে। শফিক বেঞ্চে বসামাত্র সে উঠে এসে বেঞ্চের নিচে ঢুকে পড়ল। একথালা টকে যাওয়া ডালমাখা ভাত খেয়ে সে কৃতজ্ঞতায় অস্থির হয়ে আছে।
শফিক ডাকল, কালাপাহাড়! এই কালাপাহাড়!
কালাপাহাড় সাড়া দিল। বেঞ্চের নিচ থেকে মাথা বের করে তাকাল শফিকের দিকে। শফিক বলল, কুকুর হয়ে জন্মানোর একটা সুবিধা আছে। খুব ক্ষুধার্ত হলে ডাস্টবিন ঘাটাঘাটি করলে কিছু-না-কিছু পাওয়া যায়। মানুষের এই সুবিধা নেই।
কালাপাহাড় বিচিত্র শব্দ করল। শফিকের কেন জানি মনে হলো কুকুরটা তার কথা বুঝতে পেরে জবাব দিয়েছে। শফিকের হঠাৎ করেই গায়ে কাঁটা দিল।
শফিকের মা জোবেদা খানমের একটা পোষা কুকুর ছিল। জোবেদা খানম কুকুরটাকে ‘কপালপোড়া’ বলে ডাকতেন। কেউ তার গায়ে গরম ভাতের মাড় ফেলে কপাল পুড়িয়ে দিয়েছিল। কুকুরটা জোবেদা খানমের সঙ্গে কথা বলত এবং ভদ্রমহিলার ধারণা তিনি কুকুরের সব কথা বুঝতে পারতেন।
শফিক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভাবল, আমার মা স্ফিজিওফ্রেনিয়ার রোগী ছিলেন। এইসব রোগীর ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটে।
আসলেই কি তাই? নাকি অন্যকিছু? জগৎ অতি রহস্যময়। হয়তো তার মা সত্যি সত্যি পশুপাখির কথা বুঝতেন।
এক শ্রাবণ মাসের কথা। গভীর রাত। ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। জোবেদা শফিককে ডেকে তুলে বললেন, বাবা! হারিকেন আর ছাতি নিয়ে একটু আগা তো।
শফিক অবাক হয়ে বলল, কোথায় যাব?
ঈশ্বরগঞ্জ থেকে তোর বাবা আসছে। কাঠের পুলের কাছে এসে ভয় পাচ্ছে। তোর বাবাকে একটু কষ্ট করে নিয়ে আয়।
শফিক বলল, বাবা এসেছেন—এই খবর তুমি কোথায় পেয়েছ?
কপালপোড়া আমাকে বলেছে।
কুকুরটা তোমাকে বাবার সংবাদ দিয়েছে?
হুঁ।
শফিক শীতল গলায় বলল, এক কাজ করো, কুকুরের গলায় হারিকেন ঝুলিয়ে দাও। সে বাবাকে পুল পার করে নিয়ে আসুক।
জোবেদা খানম ক্ষীণ গলায় অনুনয়ের ভঙ্গিতে বললেন, বাবা! যা-না। মায়ের অনুরোধটা রাখ। মার কথাটা শোন।
শফিক বলল, মা, তোমার কথা আমি এক শ’বার শুনব। কুকুরের কথা শুনব। কুকুরের কথায় ঝড়-বৃষ্টির রাতে কাঠের ব্রিজের কাছে যাব না।