কর্নেল ফারুক ঢাকার এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছলেন শুক্রবার ভোরে। তার হাসিমুখ দেখে এয়ারপোর্টের পুলিশ কর্মকর্তারা হকচকিয়ে গেলেন। এই মানুষটিকে কি তারা গ্রেফতার করবেন? এমন নির্দেশ তো তাদের কাছে নেই।
কর্নেল ফারুকের সহযোগী মেজর রশীদ তিন দিন আগে ঢাকা পৌঁছেছেন।
পুলিশের কাছে রিপোর্ট আছে, তিনি তাঁর ক্যান্টনমেন্টের বাসাতেই উঠেছেন। জেনারেল শিশুকে নিয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতও করেছেন। আন্তরিক পরিবেশে জিয়া তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। একসঙ্গে রাতের ডিনার করেছেন। এমন যেখানে পরিস্থিতি সেখানে আগ বাড়িয়ে পুলিশের কিছু করার নেই। তাদের কাজ শুধুই দেখে যাওয়া।
শুক্রবার ভোরে প্রেসিডেন্ট জিয়া নাশতা খাচ্ছিলেন। আয়োজন সামান্য—
চারটা লাল আটার রুটি।
দুই পিস বেগুন ভাজি।
একটা ডিম সিদ্ধ।
জিয়ার সঙ্গে নাশতার টেবিলে বসেছেন তার বন্ধু এবং সহযোদ্ধা জেনারেল মঞ্জুর।
জেনারেল মঞ্জুর বিস্মিত হয়ে বললেন, এই আপনার নাশতা?
প্রেসিডেন্ট বললেন, হতদরিদ্র একটি দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই নাশতা কি যথেষ্ট না?
জেনারেল মঞ্জুর প্রসঙ্গ বদলে বললেন, এই মুহূর্তে ঢাকা এয়ারপোর্টে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কফির মগ হাতে ঘুরছেন। সবার সঙ্গে গল্পগুজব করছেন। হাত মেলাচ্ছেন। কোলাকুলি করছেন। এই তথ্য কি আপনার কাছে আছে?
জিয়া বললেন, আছে। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও আছে।
আমি কি জানতে পারি?
পারো। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, কর্নেল ফারুক উঠবে ক্যান্টনমেন্টে রশীদের বাসায়। সেখান থেকে সে যাবে ফার্স্ট বেঙ্গল ক্যাভালরিতে।
বলেন কী?
এই অবস্থায় আপনি নির্বিকারে নাশতা করছেন?
জিয়া শান্ত গলায় বললেন, তুমি হলে কী করতে? নাশতা খাওয়া বন্ধ করে ফাস্ট বেঙ্গল ক্যাভালরিতে ছুটে যেতে?
মঞ্জর চুপ করে রইলেন। জিয়া বললেন, হিটলারের ডেজার্ট ফক্স জেনারেল রোমেলের একটি কথা আমার খুব পছন্দ। জেনারেল রোমেল বলতেন, সবাই চোখ-কান খোলা রাখে। আমি নাকও খোলা রাখি। গন্ধ শুঁকি। বিপদের গন্ধ শোঁকা যায়।
আপনি তাহলে নাক খোলা রেখেছেন।
Yes, my noses are open.
কর্নেল ফারুক পূর্ণ সামরিক পোশাকে ফাস্ট বেঙ্গল ক্যাভালরিতে উপস্থিত হয়েছেন। তারিখ চব্বিশে সেপ্টেম্বর। তাকে দেখে অফিসার এবং সৈনিকেরা উল্লাসে ফেটে পড়েছে। কর্নেল ফারুক স্বপ্নে যেমন দেখেছেন তেমন ঘটনাও ঘটল। কিছু সৈনিক তাকে কাঁধে নিয়ে চিৎকার করতে লাগল, কর্নেল ফারুক জিন্দাবাদ।
একটি ট্যাংক থেকে শূন্যে তিনবার উল্লাসের গোলা বর্ষণও করা হয়। পূর্ণ রাজকীয় সংবর্ধনা।
কর্নেল ফারুকের নিজস্ব সৈনিক বেঙ্গল ল্যান্সার বগুড়ায়। তাদের কাছে ফারুকের আগমন সংবাদ পৌঁছে গেছে।
তারা ভয়াবহ হইচই শুরু করেছে। তাদের দাবি কর্নেল ফারুক আমাদের প্রধান। তাঁকে আমাদের মধ্যে চাই। তাঁকে ছাড়া আমাদের চলবে না।
কর্নেল ফারুক বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে তার নিজের ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সারের কাছে উপস্থিত হলেন ২৫ সেপ্টেম্বর। বেঙ্গল ল্যান্সারের অফিসার ও জোয়ানদের আনন্দ এভারেস্টের চূড়া স্পর্শ করল। সেই দিনই মেজর ডালিম ব্যাংকক থেকে ঢাকায় উপস্থিত। দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত। কর্নেল ফারুক তার ট্যাংকবাহিনী নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হলেই হয়।
জিয়া প্রেসিডেন্ট ভবনে কর্নেল ফারুকের বাবাকে ডেকে এনেছেন। যথারীতি জিয়ার চোখ সন্ধ্যার পরও কালো চশমায় ঢাকা। তার চোখের ভাষা পড়ার কোনো উপায়ই নেই।
প্রেসিডেন্ট জিয়া কর্নেল ফারুকের বাবার দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, আপনার ছেলের ওপর আমি যথেষ্টই বিরক্ত হয়েছি। তাকে অনেকখানি প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, আর দেওয়া হবে না। আমি তার পরিকল্পনার কথা জানি। সে ট্যাংকবহর নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হবে। আমি আরিচা ফেরিঘাটে একটি ইনফেনট্রি রেজিমেন্ট পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা ট্যাংক রেজিমেন্ট প্রতিহত করবে। বিমান বাহিনীকেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নির্দেশ পাওয়ামাত্র তারা বোমা বর্ষণ করবে। বেঙ্গল ল্যান্সার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলেও আমার কিছু যায় আসে না। আপনি কি আমার কথা মন দিয়ে শুনছেন?
আমি আপনার কথা মন দিয়ে শুনে কিছু হবে না। আমার ছেলেকে মন দিয়ে শুনতে হবে।
আপনি তাকে শোনাবেন।
আমি শোনাব।
হ্যাঁ। একটি আর্মি হেলিকপ্টার আপনাকে আপনার ছেলের কাছে নিয়ে যাবে।
কখন?
এখন। এই মুহূর্তে। আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে এই হেলিকপ্টারেই ফেরত আসবেন।
আমার ছেলেকে কি গ্রেফতার করা হবে।
না। বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
আপনি কথা দিচ্ছেন?
প্রেসিডেন্ট জিয়া বললেন, আমি কখনোই কথা দেই না, কিন্তু আপনাকে কথা দিচ্ছি।
কর্নেল ফারুকের বৃদ্ধ পিতা ছেলেকে নিয়ে সেই হেলিকপ্টারে করেই ফিরলেন। কঠিন পাহারায় কর্নেল ফারুক, মেজর রশীদ এবং মেজর ডালিমকে ব্যাংককগামী এক প্লেনে তুলে দেওয়া হলো। কাকতালীয়ভাবে দিনটি ছিল শুক্রবার।
প্রেসিডেন্ট ভবনে জিয়াউর রহমান রাতের ডিনার সারছেন। ছোট্ট টিফিন ক্যারিয়ারে ডিনার ক্যান্টনমেন্টে তার বাসা থেকে এসেছে। মেন্যু দেওয়া হলো—
পটল ভাজি
মলা মাছের ঝোল
ডিমের ঝোল
ডাল। জিয়া
বিড়বিড় করে বললেন, আমি সবসময় বলি, ডিনার বা লাঞ্চে যেন আমাকে তিন আইটেমের বেশি না দেওয়া হয়। এরা সবসময় আমার আদেশ ভঙ্গ করে। don’t like that.