শফিকের কারণে আরও দুজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। একজন তার পোষা কুকুর কালাপাহাড়। তার গা-ভর্তি ভেড়ার লোমের মতো বড় বড় ঘন কালো লোম। প্রকাণ্ড শরীর। পুতি পুতি লাল চোখ।
কালাপাহাড় আমাকে দেখেই চাপা ক্রুদ্ধ গর্জন শুরু করল। শফিক বলল, চুপ! কালাপাহাড় চুপ। উনি আমার বন্ধু মানুষ। তাকে দেখে এ রকম শব্দ করা যাবে না। উনি ভয় পেতে পারেন। তুমি যাও তাঁর পায়ের কাছে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে থাকো।
আমাকে অবাক করে দিয়ে এই কুকুর আমার দুই পায়ের কাছে এসে মাথা নিচু করে বসল। আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনার এই কুকুর কি মানুষের ভাষা বুঝতে পারে?
শফিক বলল, সবার কথা বুঝতে পারে না। তবে আমারটা মনে হয় পারে।
আমি বললাম, অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
শফিক বলল, আমাদের ঘিরে আছে অবিশ্বাস্য সব ব্যাপার। আমরা তা বুঝতে পারি না। এই প্রসঙ্গে এডগার এলেন পো’র একটি উক্তি আছে। উক্তিটি শুনেছেন?
আমি বললাম, না। বলুন শুনি।
শফিক বলল, বলব না। আপনি এলেন পো’র রচনা পাঠ করে জেনে নেবেন। আপনি লেখক মানুষ। আপনার প্রচুর পড়াশোনা করা প্রয়োজন।
শফিকের কারণে দ্বিতীয় যার সঙ্গে পরিচয় হলো সে এক _____ অবন্তি। আমি এমন রূপবতী মেয়ে আগে কখনো দেখি নি। ভবিষ্যতে দেখব এমন মনে হয় না। দুধে আলতা গায়ের রঙ বইপত্রেই শুধুই পড়েছি, এই প্রথম চোখে দেখলাম। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর চোখ নিয়ে দুজন এসেছিলেন, একজন হলেন ইংরেজ কবি শেলী। দ্বিতীয়জন হলেন বুদ্ধদেবপুত্র কুনাল। আমি নিশ্চিত, অবন্তির চোখ ওই দুজনের চোখের চেয়েও শতগুণ সুন্দর।
মেয়েটার একটাই দোষ লক্ষ করলাম, সে কিছুক্ষণ পর পর ঠোঁট গোল করে ভুরু কুঁচকে বসে থাকে। তখন তাকে যথেষ্টই কুৎসত দেখায়। মনে হয় বিদেশি এক কুকুর বসে আছে। তার এই বাজে অভ্যাস কেউ শোধরানোর চেষ্টা কেন করে নি কে জানে।
শফিক বলল, আমার এই লেখকবন্ধুকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছি।
অবন্তি বলল, আমি কোনো লেখককে এত কাছ থেকে কখনো দেখি নি। আচ্ছা আপনি কি হাত দেখতে পারেন?
আমি বললাম, না।
অবন্তি বলল, আপনি চমৎকার একটা সুযোগ মিস করলেন। আপনি যদি হ্যাঁ বলতেন তাহলে অনেকক্ষণ আমার হাত কচলাবার সুযোগ পেতেন।
আমি হেসে ফেললাম। অবন্তি বলল, আপনার সঙ্গে আজ গল্প করতে পারব। আমার প্রচণ্ড শরীর খারাপ।
শফিক বলল, তোমার কী হয়েছে?
অবন্তি অবলীলায় বলল, মাসের কয়েকটা দিন মেয়েদের শরীর খারাপ থাকে। আমার সেই শরীর খারাপ। এখন বুঝেছেন?
আমি ছোটখাটো ধাক্কার মতো খেলাম। কোনো মেয়ের কাছ থেকে নিজের শরীর খারাপ বিষয়ে এই ধরনের কথা শুনব তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল।
অবন্তির সঙ্গে দেখা হওয়ার একুশ বছর পর আমি একটি উপন্যাস লিখি। উপন্যাসের নাম লীলাবতী। লীলাবতীর রূপ বর্ণনায় আমি অবন্তিকে চোখের সামনে রেখেছিলাম।
তারিখ নভেম্বর ২৪ (১৯৭৫)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে বসে আছি। আনোয়ারের জন্যে অপেক্ষা করছি। আজ আনোয়ার আমাকে কর্নেল তাহেরের কাছে নিয়ে যাবে। কর্নেল তাহের যে তখন পলাতক, এস এম হলে পদার্থবিদ্যার একজন লেকচারারের ঘরে লুকিয়ে আছেন, সেই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।
দিনটা ছিল মেঘলা। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। আনোয়ার আসতে দেরি করছে। আমি তৃতীয় কাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছি। তখন ক্লাবের বেয়ারা এসে বলল, অধ্যাপক রাজ্জাক সাহেব আমাকে ডাকছেন। হ্যারল্ড লাসকির ছাত্র অধ্যাপক রাজ্জাক (পরে জাতীয় অধ্যাপক) তখন কিংবদন্তি মানুষ। তিনি আমাকে চেনেন এবং আমাকে ডাকছেন শুনে খুবই অবাক হলাম।
রাজ্জাক স্যারের সামনে দাঁড়াতেই বললেন, আসেন দাবা খেলি।
রাজ্জাক স্যার বিখ্যাত দাবা খেলোয়াড়। তার সঙ্গে কী খেলব। তারপরেও খেলতে বসলাম। খেলা কিছুদূর অগ্রসর হতেই আনোয়ার এসে উপস্থিত। আমি বললাম, আজ তো আর যেতে পারব না। স্যারের সঙ্গে খেলতে বসেছি।
আনোয়ার হতাশ মুখে বলল, বুঝতে পারছি।
দাবা খেলা সেদিন আমাকে মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করল। আমি কর্নেল তাহেরের সঙ্গে পুলিশের হাতে ধরা পড়লাম না। জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ওই দিনই দশ হাজার জাসদ কর্মীর সঙ্গে কর্নেল তাহের গ্রেফতার হলেন।
দশ হাজার জাসদকর্মীর সঙ্গে আদর্শলিপি প্রেসের শফিকও গ্রেফতার হয়। তার অপরাধ আদর্শলিপি প্রেস থেকে জাসদের প্রপাগান্ডা ছাপা হয়।
কর্নেল তাহেরকে মুক্ত করার জন্য দুদিন পর (২৬ নভেম্বর) জাসদ এক সাহসী পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনার মূল বিষয় বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে অপহরণ এবং পরে তার মুক্তির বিনিময়ে কর্নেল তাহেরের মুক্তি।
পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। অভিযানের ছয় নায়কের মধ্যে চারজনই সমর সেনের নিরাপত্তাকর্মীর হাতে নিহত হন। চারজনের একজন হলেন কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই। নাম সাখাওয়াত হোসেন। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহসিকতার জন্যে তাকে ‘বীর প্রতীক’ সম্মানে দু’বার সম্মানিত করা হয়েছিল।
মিথ্যা এক অভিযোগ আনা হলো কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে। তিনি নাকি ১৯৭৫ সনের ৭ নভেম্বর এক বৈধ সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালান। হায়রে রাজনীতি!
মহাবীর কর্নেল তাহেরের পরিচয় নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই। তারপরেও সামান্য দিচ্ছি।
১৪ নভেম্বর ১৯৩৮ সনে জন্ম। বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ, মা আশরাফুন্নিসা।
সিলেটের এমসি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের দুর্গাপুর উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবনের শুরু।