ঘরে পোলাও, খাসির রেজালা এবং ডিমের কোরমা রান্না হয়েছে। বাসায় অপরিচিত একজন অতিথিও এসেছেন। ছোটখাটো মানুষ, গাত্রবর্ণ কালো। সারাক্ষণ হাসছেন। তাঁর নাম আশরাফুন্নিসা। কর্নেল তাহেরের মা। তিনি নাকি কাছ থেকে কোনো লেখক দেখেন নি। লেখক দেখতে এসেছেন।
তিনি আমাকে দেখে হাসতে হাসতে বললেন, হুমায়ূন ব্যাটা! আমাকে সালাম করো। আমি তোমার আরেক মা।
আমি তৎক্ষণাত তাঁকে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথার ঘ্রাণ কে বললেন, ঠিক আছে।
কী ঠিক আছে তা কখনো তাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি।
আমি তাকে না চিনলেও তার ছোট ছেলে আনোয়ারকে খুব ভালো করে চিনি। আনোয়ার তখন আমার মতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। মাঝে মধ্যে ক্লাসের শেষে আমরা দু’জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে বসে চা খাই।
আনোয়ারের মাথায় বিপ্লবী সিরাজ সিকদার এবং তার ভাই কর্নেল তাহের নানান আইডিয়া ঢুকিয়ে দিয়েছেন। সেইসব আইডিয়ার কারণে আনোয়ারের সব গল্পই দেশ বদলে দেওয়ার গল্প। তবে আনোয়ার যে সিরাজ শিকদার গ্রুপের এক সক্রিয় সদস্য তা আমাকে সে জানায় নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের লাউঞ্জে আনোয়ারের সব গল্প শেষ হয় চা শেষ করে একটা কথায় হুমায়ূন, চলো তো আমার সঙ্গে।
কোথায়?
তাহের ভাইয়ের কাছে। উনি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
উনি আমাকে চেনেন কীভাবে?
আমি তোমার কথা ভাইজানকে বলেছি, উনি তোমার বইও পড়েছেন। আমরা সব ভাইবোন বইয়ের পোকা।
আজ না। আরেক দিন যাব।
কবে যাবে?
কোনো-এক শুভদিনে যাব।
আনোয়ারের তখন পুরনো একটা মোটর সাইকেল ছিল। তাকে অকারণে মোটর সাইকেলে ঘুরতে দেখতাম।
আনোয়ার এবং কর্নেল তাহেরের মা বেগম আশরাফুন্নিসাকে আমি আমার মায়ের মতোই দেখেছি। তিনি আমাকে ডাকতেন হুমায়ূন ব্যাটা’। তাঁর ডাকের সঙ্গে আমার বাবার ডাকেরও মিল ছিল। বাবা আমাকে ডাকতেন—বড় ব্যাটা হুমায়ূন’।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা আমার নিজের খুব পছন্দের বই আগুনের পরশমণি আমি বেগম আশরাফুন্নিসাকে উৎসর্গ করি।
উৎসর্গপত্রে লেখা–
বীর প্রসবিনী
বেগম আশরাফুন্নিসা
কর্নেল তাহেরসহ
আটজন মুক্তিযোদ্ধার জননী।
উৎসর্গপত্রে সামান্য ভুল আছে। বেগম আশরাফুন্নিসা আটজন মুক্তিযোদ্ধার জননী না, তিনি নয়জন মুক্তিযোদ্ধার জননী। তাঁর সাত পুত্র এবং দুই কন্যা মুক্তিযোদ্ধা। এই নয়জনের মধ্যে চারজন মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্যে বীরত্বসূচক পদকের অধিকারী। কর্নেল তাহের বীর উত্তম, এক ভাই ইউসুফ বীর বিক্রম, দুই ভাই বীর প্রতীক। এই বীর প্রতীক এঁরা পেয়েছেন দু’বার করে।
এই প্রসঙ্গে আমি আবার ফিরে আসব। এখন চলে যাই নীলহাতি’তে।
খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানির মালিক খান সাহেব ‘নীলহাতি’ বই হিসেবে ছাপাতে রাজি হলেন। তবে বিরক্ত মুখ করে বললেন, আপনি যে সব লিখছেন বাচ্চারা এইগুলা পড়বে না। ছোট ছোট ডিটেকটিভ বই লেখেন। স্বপন কুমার টাইপ দুই টাকা সিরিজের—মাসে দু’ মাসে একটা করে বের হবে। পারবেন?
আমি বললাম, জি পারব।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্যাশ থেকে এক শ টাকা দিলেন ডিটেকটিভ বইয়ের জন্যে অগ্রিম সম্মানী। তিনি বললেন, একটা ডিটেকটিভ বই আগে লিখে দেন, তারপর আমি আপনার ‘নীলহাতি’ ছাপব। নীলহাতি বইয়ের সুন্দর কভার লাগবে। কাইয়ুম চৌধুরীকে দিয়ে হবে না, উনি দশ বছর লাগাবেন। দেখেন অন্য কাউকে পান কি না।
নীলহাতির প্রচ্ছদশিল্পী খুঁজতে গিয়ে আমার আদর্শলিপি প্রেসের শফিকের সঙ্গে পরিচয়।
শফিক ছোটখাটো মানুষ। শ্যামলা রঙ। চোখের পাপড়ি মেয়েদের মতো দীর্ঘ বলেই হয়তো চেহারায় মেয়েলি ব্যাপার আছে। তাকে ঘিরে আশ্চর্য এক স্নিগ্ধতা আছে। আমি অল্প কিছু মানুষের ভেতর এই বিষয়টি দেখেছি।
শফিক আমাকে বসিয়ে রেখেই নীলহাতি’র গল্প পড়ে ফেলল। ছয়-সাত পাতার গল্প, বেশি সময় লাগার কথা না। গল্প শেষ করে গম্ভীর গলায় অতি প্রশংসাসূচক একটি বাক্য বলল। প্রিয় পাঠক, এই বাক্যটি উপন্যাসে ব্যবহার করতে আমার লজ্জা লাগছে। তারপরেও ব্যবহার করছি। শফিক বলল, আপনি যে অনেক বড় একজন গল্পকার, গ্রীম ব্রাদার্সদের মতো, তা কি আপনি জানেন?
আমি হেসে ফেলে বললাম, জানি। দেশের মানুষ তো জানে না।
আমি বললাম, একদিন হয়তো জানবে। আবার হয়তো জানবে না। আমাদের নিয়ন্ত্রণ তো আমাদের হাতে নেই। অন্য কারও হাতে। আমরা পুতুলের মতো নাচছি। সবই ‘পুতুল নাচের ইতিকথা।
আপনি অদৃষ্টবাদী?
হ্যাঁ।
মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরেছেন?
হ্যাঁ।
কতবার?
একবার।
আরও দু’বার মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরবেন। তাই নিয়ম।
আমি শফিকের কথায় যথেষ্টই আনন্দ পেলাম।
শফিক বলল, আমি নিজেও অদৃষ্টবাদী। তবে আপনাকে অদৃষ্টবাদী হলে চলবে না। বড় লেখকেরা জীবনবাদী হন। অদৃষ্টবাদী হন না।
দুপুরে শফিক আমাকে ছাড়ল না। তার সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে হলো। রান্না করেছেন শফিকের মা। শফিক তাকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে। দ্রমহিলা নির্বাক-প্রকৃতির। ছেলের সঙ্গেও কথা বলেন না। ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখেন।
শফিক বলল, মার ধারণা তিনি কুকুরের কথা বুঝতে পারেন। তাঁর একটা কুকুর ছিল, নাম ‘কপালপোড়া’। মা ওই কুকুরের সঙ্গে কথা বলতেন। এখন আমার কুকুরের সঙ্গে কথা বলেন।
আপনার কুকুর আছে নাকি?
হ্যাঁ আছে। নাম দিয়েছি কালাপাহাড়।
শফিকের আদর্শলিপি প্রেসে ওইদিন দুপুরের খাবারের কথা আমার বাকি জীবন মনে থাকবে। কারণ ওইদিন শফিকের মায়ের রান্না করা অদ্ভুত এক খাবার খেয়েছিলাম—আমের মুকুল দিয়ে মৌরলা (মলা) মাছ। অনেককেই এই খাবার তৈরি করে দিতে বলেছি। কেউ রেসিপি জানে না বলে তৈরি করে দেয় নি। শফিকের মাও দ্বিতীয়বার এই খাবার রান্না করেন নি। তিনি আসলে সিজিওফ্রেনিয়ার রোগী ছিলেন। মাঝে মাঝে তার রোগের প্রকোপ বেড়ে যেত। তখন তিনি দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতেন। সারাক্ষণ অদৃশ্য এক কুকুরের সঙ্গে কথা বলতেন। শফিক তাকে ডাকলে কুকুরের মতোই শব্দ করতেন। এই মহিলার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের এক চিকিৎসক। আমি তার নাম ভুলে গেছি। এই চিকিৎসক শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ক্যানসারের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে তার মৃত্যু তরান্বিত করেছিলেন।