কালাপাহাড় চাপা আওয়াজ করছে। সে বসেও নেই, শরীর টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তাকে ভীত এবং শংকিত মনে হচ্ছে। অবন্তি বলল, আপনার কুকুরটা এরকম করছে কেন?
শফিক বলল, জানি না কেন এরকম করছে।
অবন্তি বলল, আমি জানি কেন এরকম করছে। আপনি খাওয়াদাওয়া শেষ করুন, তারপর আপনাকে বলব। শুনে আপনার বিশ্বাস হবে না। তবে আমি মিথ্যা বলি না। আমার দাদাজানের, আমার বাবা এবং মা’র প্রচুর মিথ্যা বলার অভ্যাস। কিন্তু আমি এই সমস্যা থেকে মুক্ত।
রাত এগারটা বাজে। শফিক রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুমুতে গেছে। তাকে জায়গা দেওয়া হয়েছে গেস্টরুমে। অবন্তি জগভর্তি পানি এবং গ্লাস দিয়ে গেল। শফিক বলল, আমার কিছু লাগবে না। তুমি ঘুমুতে যাও।
অবন্তি বলল, আমি পাঁচ মিনিট পরে যাব। আমি একটা ভয়ংকর দৃশ্য দেখেছি। এই দৃশ্যের কথা বলব। আপনি ঠান্ডা মাথায় শুনবেন। যদি কোনো ব্যাখ্যা দাঁড়া করতে পারেন সেটাও বলবেন।
শফিক বলল, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব টেনড়। গল্প বলে টেনশন কমাও। আমার নিজের জীবনে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটেছে। এই প্রসঙ্গে তোমাকে কাল ভোরে বলব। এখন তোমার গল্প শুনি।
অবন্তি গল্প শুরু করল।
সাতই নভেম্বরের কথা। দাদাজান ফিরছেন না। ঘরে আমি আর রহিমা। দারোয়ান কালামকে পাঠিয়েছি দাদাজানের পরিচিত সব বাসায়। কেউ যদি কোনো খবর দিতে পারে।
তখন রাত বারোটার ওপর বাজে। আমি ছাদে বসে আছি। ছাদ থেকে অনেকদূর দেখা যায়। রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ ফাঁকা। কুকুর-বিড়াল পর্যন্ত নেই। হঠাৎ দেখি লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা একজন লোক আসছে। তার মধ্যে কোনো-একটা সমস্যা আছে। সমস্যাটা ধরতে পারছি না।
লোকটা যখন এসে আমাদের বাড়ির গেটের দরজা খুলল তখন সমস্যাটা ধরতে পারলাম। তার চোখ নেই, মুখ নেই, নাক নেই। আমি ভয়ে আতংকে অস্থির হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে গেট খুলে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল।
জিনিসটা কী আমি জানি না। তবে সে এই বাড়িতেই আছে তা জানি। কুকুরবিড়ালরা এইসব বুঝতে পারে বলেই আপনার কুকুর এত হইচই করছিল।
শফিক বলল, Oh God!
অবন্তি বলল, ভয়ংকর গল্প না?
শফিক বলল, অবশ্যই ভয়ংকর।
অবন্তি হতাশ গলায় বলল, আমি বুঝতে পারছি—আমার এ বাড়িতে থাকা ঠিক না। যে-কোনো সময় বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। কিন্তু আমি কোথায় যাব বলুন? আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
তুমি তোমার মার কাছে চলে যাও।
মা টিকিট পাঠাবে বলেছিল। এখনো পাঠায় নি। তা ছাড়া আমার পাসপোর্টও করা নেই।
শফিক বলল, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।
হঠাৎ শফিক চুপ করল। বিস্মিত হয়ে তাকাল অবন্তির দিকে।
অবন্তি বলল, মনে হচ্ছে না ছাদে কেউ হাঁটছে?
শফিক বলল, হ্যাঁ।
অবন্তি বলল, ওই জিনিসটা হাঁটছে। আপনার যদি সাহস থাকে তাহলে চলুন দু’জন মিলে ছাদে যাই। চাক্ষুষ দেখি ঘটনা কী।
শফিক বলল, আমি সাহসী মানুষ না অবন্তি। আমি ভীতু মানুষ। ছাদে কী হচ্ছে তা জানার দরকার নেই। তুমি ঘুমাতে যাও। আমার ঘুম হবে না। আমি সারা রাত জেগেই থাকব। তাতে সমস্যা নেই।
কালাপাহাড় চাপা স্বরে ডেকেই যাচ্ছে। সে কী দেখছে, কে জানে!
ক্যান্টনমেন্টের উত্তাপ
ক্যান্টনমেন্টের উত্তাপ ঢাকা শহরে প্রবেশ করল না। শহর তার নিজের নিয়মে চলতে লাগল। শান্ত নিস্তরঙ্গ ঢাকা শহর।
মাঠাওয়ালারা মাঠা মাঠা বলে মাঠা বিক্রি করতে লাগল। ধুনুরিরা কাঁধে ধুন নিয়ে লেপ-তোষক সারাইয়ে নেমে গেল। ছুরি-কাঁচি ধার করানোর লোকও নামল। মিষ্টি গলায় বলতে লাগল, ছুরি-কাঁচি ধার করাইবেন? সে বছর প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়ল। আমি আমার জীবনে এত সস্তা ইলিশ দেখি নি। ইলিশ মাছ সস্তা হওয়া মানে অন্যান্য মাছ ও শাকসবজির দাম কমে যাওয়া। তা-ই হলো। ঢাকা শহরবাসীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তাদের কাছে মনে হলো জিয়া সরকার দেশের জন্য মঙ্গল নিয়ে এসেছে।
আমি তখন খুবই কষ্টে জীবন কাটাচ্ছি। বাবার পেনশনের সামান্য টাকা এবং কেমেস্ট্রির লেকচারার হিসেবে আমার বেতনে ছয় ভাইবোন এবং মাকে নিয়ে বিশাল সংসার চলছে। চলছে বলা ঠিক হবে না, আটকে আটকে যাচ্ছে। গাড়ি চলে না চলে না’-টাইপ চলা। মাসের শেষদিকে আমাকে এবং মা’কে ধারের সন্ধানে বের হতে হচ্ছে। ধার দেওয়ার মতো মানুষের সংখ্যাও তখন সীমিত। যারা আছেন তারা আমাকে এবং মা’কে ধার দিতে দিতে ক্লান্ত বিরক্ত।
এই প্রবল দুঃসময়ে বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত ভাই একদিন আমাকে বললেন, বিচিত্রা গ্রুপ থেকে বাচ্চাদের একটা পত্রিকা বের হবে। প্রথম সংখ্যায় একটা লেখা দিতে পারবেন?
আমি এত জোরে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালাম যে মাথা ছিঁড়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। রাত জেগে লিখলাম নীলহাতি। শিশু-কিশোরদের জন্যে জীবনের প্রথম লেখা। এই লেখার চালিকাশক্তি সাহিত্যসৃষ্টি ছিল না, কিঞ্চিত অর্থোপার্জন ছিল।
লেখা প্রকাশিত হলো এবং আমি সম্মানী হিসেবে কুড়ি টাকা পেলাম। পরিষ্কার মনে আছে—এই টাকায় এক সের খাসির মাংস, পোলাওয়ের চাল এবং ঘি কেনা হলো। অনেকদিন ভালো খাবার খাওয়া হয় না। একদিন ভালো খাবার।
গ্রামবাংলায় একটি কথা চালু আছে, যেদিন উত্তম খাবার রান্না হয় সেদিন যদি হঠাৎ কোনো অতিথি উপস্থিত হন তখন ধরে নিতে হবে উত্তম খাবারের উপলক্ষ
সে অতিথি। তখন অতিথিকে যথাযোগ্য সমাদর করতে হবে।