শশাংক বললেন, বলতে পারি। তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম। আপনার নাম মনে এসেছে, বলে ফেলেছি। এই তথ্য জেনেছেন কার কাছ থেকে? পুলিশের কাছ থেকে?
শফিক বলল, এটা আমার অনুমান। আমার অনুমানশক্তি ভালো। আমি অনুমানে পাচ্ছি রাধানাথ বাবুর মৃত্যুর সঙ্গে আপনি জড়িত। রাধানাথ বাবু মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে যারা জড়িত, তারা কেউ পার পাবে বলে আমি মনে করি না। Everybody is paid back by his own coin. সবাইকে নিজের পয়সায় হিসাব দিতে হয়। আপনাকেও দিতে হবে।
আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন?
না। আমি কাউকে ভয় দেখাই না।
শশাংক গলা নিচু করে বললেন, শফিক সাহেব শোনেন। আমাদের দু’জনেরই দু’জনকে প্রয়োজন, এটা মাথার মধ্যে রাখবেন। দলিল-দস্তাবেজ গাপ করে দিলে আপনি কিছুই পাবেন না। বুড়া আঙুল চুষবেন। রাধানাথ বাবুর দূরসম্পর্কের এক ভাগ্নে আছে। পরিমল। বিরাট মস্তান। সিনেমাহলের গেটকিপার। সে খবর পেলে ছুটে এসে সবকিছু দখল করবে। বুঝলেন ঘটনা?
শফিক চুপ করে রইল। শশাংক বললেন, এত বড় বিষয়সম্পত্তি পেয়েছেন, আসুন সেলিব্রেট করি। মাল খাওয়ার অভ্যাস আছে?
মাল কী?
কারণ বারিকে বলে মাল। সহজ ভাষায় মদ। দেবদাস যে জিনিস খেয়ে লিভার পচিয়ে ফেলেছিল সেই জিনিস।
আমার মদ্যপানের অভ্যাস নেই।
অভ্যাস নেই, অভ্যাস করুন। নিজের রোজগারের ধন উড়ানো যায় না। পরের ধন উড়ানো যায়। আমার কাছে ভালো বিলাতি জিনিস আছে। স্কটল্যান্ডে যেই জিনিসের জন্ম। আসুন দুই ভাই মিলে ফিনিশ করে দেই।
শফিক বলল, আপনি একা ফিনিশ করুন, আমি এখন উঠব।
যাবেন কোথায়? রাধানাথ বাবুর শোবার ঘরে শুয়ে থাকুন। সবই তো আপনার।
শফিক কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল। শশাংক বললেন, রিকশা করে কিংবা হেঁটে হেঁটে যাবেন না। এখন আপনার গাড়ি আছে। চলাফেরা করবেন গাড়িতে। যে কদিন পারেন পরের ধনে পোদ্দারি করে যান। আসমান থেকে যে ধন আসে সেই ধন আবার আসমানে উঠে যায়। বুঝলেন?
বোঝার চেষ্টা করছি।
শশাংক বললেন, বুড়ো রাধানাথ কেন সব সম্পত্তি আপনাকে দিয়ে গেছে তার কারণ আমি বের করেছি। শুনতে চান?
চাই।
আপনার যেমন অনুমানশক্তি ভালো, আমারও ভালো। চিরকুমার রাধানাথ বাবুর আপনি ছিলেন যৌনসঙ্গী। চিরকুমারদের মধ্যে এইসব আলামত থাকে।
শফিক বলল, মহাপুরুষ পর্যায়ের একজন মানুষকে আপনি আপনার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন।
শশাংক মুখ কুঁচকে বললেন, মহাপুরুষ মহাপুরুষ করবেন না। মহাপুরুষ থাকে ডিকশনারিতে। ডিকশনারির বাইরে থাকে বিকারগ্রস্ত পুরুষ।
শফিকের জীবনে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে তা তাকে দেখলে মনে হবে না। সে মাথা নিচু করে হাঁটছে। তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে কালাপাহাড়। শফিক কালাপাহাড়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে এগুচ্ছে। শফিকের এখন ধারণা কালাপাহাড় তার সব কথা বুঝতে পারে।
কেমন আছিসরে কালাপাহাড়? ভালো থাকলে একবার ঘেউ করবি। খারাপ থাকলে দুইবার।
ঘেউ।
তাহলে ভালোই আছিস! গুড। আমিও ভালো আছি। লটারির টিকিট পেয়েছি। লটারি কী বুঝিস? বুঝতে পারলে একবার ঘেউ বলবি। না পারলে দুইবার।
ঘেউ ঘেউ।
লটারি হলো কোনো কারণ ছাড়াই টাকাপয়সা পাওয়া। আরও সহজ করে বলি। মনে কর, তুই একা একা হাঁটছিস। হঠাৎ আকাশ থেকে তোর সামনে একটা প্যাকেট পড়ল। তুই কাছে গিয়ে দেখলি প্যাকেটভর্তি বিরিয়ানি। চালের চেয়ে মাংস বেশি। কী বললাম, বুঝতে পারলি? বুঝতে পারলে একবার ঘেউ কর।
ঘেউ।
রাতে কী খেতে চাস বল। লটারির খানা খাবি? লটারির খানা কী জিনিস বুঝতে পারছিস না? আমরা অবন্তিদের বাড়িতে যাব। অবন্তি দরজা খুললে তাকে বলব, অবন্তি, প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে। কোনো খাবারের ব্যবস্থা কি করতে পারবে? অবন্তি যেসব খাবার সামনে দেবে তা হবে লটারির খাবার। বুঝেছিস?
অবন্তিদের বাড়িতে অবন্তি গত তিন দিন হলো সম্পূর্ণ একা বাস করছে। কাজের মেয়ে রহিমা একবেলার জন্যে তার বোনের বাড়িতে গিয়েছিল, আর ফিরে নি। বাড়ির দারোয়ান কালাম কাজের মেয়ের খোঁজে গিয়ে আর ফিরে নি। অবন্তির ধারণা, পুরো ঘটনাটা এই দু’জন যুক্তি করে ঘটিয়েছে। টাকাপয়সাও সরিয়েছে।
সরফরাজ খানের বিছানার পাশের টেবিলে লালরঙের ছোট্ট ট্রানজিস্টার রেডিও ছিল। সেই রেডিও এখন দেখা যাচ্ছে না।
কালাম না ফেরায় অবন্তি আনন্দিত। সরফরাজ খান নিখোঁজ হওয়ার পরপরই কালামের আচার-আচরণে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। সে অন্যরকম দৃষ্টিতে এখন অবন্তিকে দেখে। এইসব দৃষ্টি মেয়েরা খুব ভালো বুঝতে পারে।
অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর অবন্তি এসে দরজা খুলল। শফিক বলল, ঘরে কি কোনো খাবার আছে? আমি এবং কালাপাহাড় আমরা দুজনেই খুব ক্ষুধার্ত।
আছে। ঘরে প্রচুর খাবার আছে।
তোমাকে এমন অসুস্থ লাগছে কেন? শরীর খারাপ?
অবন্তি বলল, শরীর ঠিকই আছে, শুধু আমার দাদাজান নিখোঁজ হয়েছেন।
বলো কী?
আমার ধারণা উনি মারা গেছেন। আপনার পক্ষে কি আজ রাতটা এই বাড়িতে থাকা সম্ভব? আমি একা বাস করছি। রাতে একফোটা ঘুমাতে পারছি না।
শফিক বলল, আমি থাকব, কালাপাহাড় থাকবে। তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাও।
অবন্তি বলল, থ্যাংক ইউ।
শফিক বলল, আমি সকাল থেকেই তোমার দাদাজানের খোঁজে নেমে পড়ব। পাত্তা বের করে ফেলব। কালাপাহাড়কে রেখে যাব, সে তোমাকে পাহারা দেবে।