কর্নেল তাহেরকে অবন্তি ভালো চেনে। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে তিনি অবন্তিদের বাড়িতে দু’বার এসেছেন। দেশ পরিচালনায় তাঁর চিন্তাভাবনা অবন্তিকে আগ্রহ নিয়ে বলেছেন।
অবন্তি কাঁদতে কাঁদতে বলল, তাহের চাচা, উনি কি বীরের মতো মারা গেছেন?
কর্নেল তাহের বললেন, হ্যাঁ। তিনি মেজর হুদাকে বলেছিলেন, সাধারণ সৈনিকেরা কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের হত্যা করবে। তাদের কাছে জীবন ভিক্ষা করে নিজেকে ছোট করবে না। মৃত্যুর জন্যে তৈরি হও। নাও একটা সিগারেট খাও। তাঁকে যখন গুলি করা হয় তখন তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতেই সিগারেট টানছিলেন। অবন্তি মা, কাঁদবে না। Be a brave girl, খালেদ মোশাররফের ধ্যান-ধারণা আমার পছন্দ না রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা। তারপরেও সাহসী মানুষ হিসেবে আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি।
অবন্তি তার দাদাজানের অপেক্ষায় পুরো রাত ছাদে জেগে কাটাল। ভোররাতে সে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখল। এই দৃশের কথা পরে বিস্তারিত বলা হবে।
রাধানাথ বাবুর আদর্শলিপি প্রেসের সামনে
রাধানাথ বাবুর আদর্শলিপি প্রেসের সামনে শফিক দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক বুঝতে পারছে না—সে কি বাড়িতে ঢুকবে, নাকি গেট থেকে চলে যাবে? যে মানুষটার জন্যে এই বাড়ি তার নিজের মনে হতো, সেই মানুষ তো নেই। আজ আর তাকে কেউ বলবে না, টিসিবির একটা স্লিপ আছে, নিয়ে যাও। একটা প্যান্ট বানাও। এক প্যান্ট কত দিন পরবে? প্যান্ট বেচারারও তো বিশ্রাম দরকার।
শফিকের পাশেই কালাপাহাড়। সে থাবা গেড়ে বসে আছে। তাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। শফিক বলল, কালাপাহাড়, ভেতরে যাব? নাকি গেট থেকে চলে যাব?
কালাপাহাড় ঘেউ করে জবাব দেওয়ার আগেই আদর্শলিপি প্রেসের পিয়ন ফণির গলা শোনা গেল, আরে শফিক স্যার!
শফিক বলল, কেমন আছ ফণি?
ফণি বলল, আমরার কথা বাদ দেন। আপনে ছিলেন কই? আপনেরে সবে। মিল্যা হারিকেন জ্বালায়া খুঁজতাছে। আপনেরে না পাইয়া ম্যানেজার শশাংক বাবু পাগলা কুত্তার মতো হইছেন।
প্রেসের ভেতর থেকে ট্রেডল মেশিনের ঘটঘট শব্দ আসছে। এর অর্থ মেশিন চলছে। জগতে কারও জন্যে কিছু আটকে থাকে না, এটাই মনে হয় আদি সত্য।
স্যার, ভিতরে আসেন। ম্যানেজার সারের সঙ্গে কথা বলেন। উনি আপনের জন্যে বিশেষ ব্যস্ত।
শশাংক তার জন্যে বিশেষ ব্যস্ত শুনে শফিক খানিকটা গুটিয়ে গেল। প্রেসের ম্যানেজার শশাংক তাকে কোনো-এক বিচিত্র কারণে অপছন্দ করে। শফিক বলল, আমাকে প্রয়োজন কেন?
শশাংক বাবুরে জিগান, সে-ই আপনেরে বলবে। আপনের জন্যে বিরাট ভালো খবর আছে।
শফিক বলল, বিরাট ভালো খবরটা তোমার মুখেই শুনি।
ফণি বলল, রাধানাথ বাবু এই প্রেস আর তার বিষয়সম্পত্তি সব আপনেরে দিয়া গেছেন। তার মৃত্যু হইলে আপনেরে মুখাগ্নি করতে বলে গেছেন। আপনেরে না পাইয়া শশাংক বাবু মুখাগ্নি করেছেন।
হতভম্ব শফিকের মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে যা ঘটছে তা স্বপ্নের কোনো অংশ। স্বপ্নে অতি অবাস্তব বিষয়ও বাস্তব মনে হয়। রাধানাথ বাবু কেন শুধু শুধু শফিককে সব দান করবেন? সে তার কে? বিষয়টা স্বপ্নে ঘটছে। ইচ্ছাপূরণ স্বপ্ন। শফিক এক ধরনের ঘোর নিয়ে প্রেসে পা দিল। ম্যানেজারের খুপড়ি ঘরে প্রবেশ করল।
ম্যানেজার শশাংক বললেন, খবর পেয়েছেন না?
কী খবর?
রাধানাথ বাবুর সব বিষয়সম্পত্তির আপনি ওয়ারিশ।
শফিক বলল, কেন?
শশাংক বিরক্তমুখে বললেন, আমি কী করে বলব কেন? যিনি বলতে পারতেন তিনি খুন হয়েছেন। আপনি এসেছেন ভালো হয়েছে। সব আমার কাছ থেকে বুঝে নিন। আমি এই পাজির দেশে থাকব না। ইন্ডিয়া চলে যাব। ইন্ডিয়াতে আমার জ্যাঠা আছেন। প্রেস চালাবার জন্যে আপনার একজন ভালো ম্যানেজার লাগবে। প্রেস বিক্রি করে ক্যাশ টাকাও নিতে পারেন। যেটা আপনার ইচ্ছা। যদি বিক্রি করতে চান, আমাকে বলবেন। আমার হাতে ভালো খদ্দের আছে।
ম্যানেজার চোখমুখ কুঁচকে শফিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার হাতে পাইপ। তিনি বেশ কায়দা করে পাইপে টান দিচ্ছেন। শফিক এই পাইপ চেনে। রাধানাথ বাবুর পাইপ।
রাধানাথ বাবু উইল করে শফিককে যা দিয়ে গেছেন তা হলো—
১. ধানমণ্ডি তিন নম্বর রোডে দশ কাঠার একটি জমি। জমির ওপর বিশাল একতলা বাড়ি আছে। বাড়িটা ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশনের কাছে ভাড়া দেওয়া।
২. একটি ভক্স ওয়াগন গাড়ি এবং একটি পিকআপ। পিকআপ পুরোনো হলেও ভক্স ওয়াগন গাড়িটা নতুন।
৩. ব্যাংকে জমা একুশ লাখ ছাব্বিশ হাজার টাকা।
৪. আদর্শলিপি ছাপাখানা।
৫. মোহাম্মদপুরে বিশ কাঠার একটা প্লট।
৬. সাভারে দশ একর জায়গা নিয়ে একটা বাগানবাড়ি।
শশাংক বাবু বড় করে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললেন, ভগবান যাকে দেন দশ হাতে দেন। আপনাকে দিয়েছেন। ছিলেন স্ট্রিটবেগার। হয়েছেন মহারাজা।
শফিক বলল, ভগবান আমাকে কিছু দেন নি। রাধানাথ বাবু দিয়েছেন।
জিনিস একই। ভগবান তো নিজের হাতে কিছু দিবেন না। অন্যের হাতেই দিবেন। যাই হোক, বিষয়সম্পত্তি, ব্যাংকের টাকাপয়সা সবই আপনাকে আমি বুঝিয়ে দিব। কোনো ঝামেলা করব না। বিনিময়ে আপনি আমাকে দশ লাখ টাকা দিবেন। খালি হাতে ইন্ডিয়া যেন না যাই। রাজি আছেন? মাত্র দশ লাখ চেয়েছি। সামান্যই চেয়েছি।
ম্যানেজার শশাংকের কথার জবাব না দিয়ে আচমকা শফিক বলল, আপনি কি পুলিশের কাছে রাধানাথ বাবুর খুনির সন্দেহভাজনের তালিকায় আমার নাম বলেছেন?