মোশতাক বললেন, ভালো। শইল টিপার লোক কি রাখছেন?
না।
হামিদ বলল, আছেন আর অল্প কিছুদিন। শইল টিপার লোক না হইলেও চলবে।
হামিদের কথা শুনে মোশতাক হতভম্ব। অল্প কিছুদিন আছেন—এর মানে কী? তিনি এখন সবকিছু থেকে অবসর নেওয়া একজন মানুষ। মারামারি কাটাকাটির মধ্যে তার থাকার কিছু নেই। তিনি চেষ্টায় আছেন কানাডায় তার ভাগ্নির কাছে চলে যেতে। দেশ গোল্লায় যাওয়া শুরু করেছে, গোল্লায় যাক। তিনি কানাডার মন্ট্রিলে থাকবেন তার ভাগ্নির কাছে। সেখানে বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে নাকি হরিণ আসে। হাত থেকে খাবার খায়। তিনি সেখানে হরিণকে খাবার খাওয়াবেন। খুব যখন ঠান্ডা পড়বে তখন ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে আগুন তাপাবেন।
লালপানি খাওয়ার অভ্যাস তার নেই। তবে শীতের দেশে খাওয়া যেতে পারে। কথায় আছে—যস্মিন দেশে যদাচার। খুব ঠান্ডা পড়লে লালপানির বোতল নিয়ে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসলে কার কী বলার থাকবে? আর যাই হোক ছোকড়া মেজররা তাকিয়ে থাকবে না।
খালেদ মোশাররফ কফির মগ হাতে বসে আছেন। সিপাহী বিদ্রোহের কথা তাকে জানানো হয়েছে। অবস্থা যে ভয়াবহ এই খবরও দেওয়া হয়েছে। সাধারণ সৈনিকদের হইচই এবং স্লোগান শোনা যাচ্ছে। শুধু স্লোগান দিয়েই তারা চুপ করে থাকছে না, কিছুক্ষণ পরপর আকাশে গুলি বর্ষণ করছে। তাদের স্লোগান হলো
সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই
অফিসারদের রক্ত চাই।
খালেদ মোশাররফ অফিস মেসে বসে আছেন। তাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। তবে তার দীর্ঘদিনের সাথী রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ছুটে আসা মেজর হুদা ও মেজর হায়দারকে আতংকে অস্থির হতে দেখা গেল। তারা বারবার জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে নানান জায়গায় টেলিফোন করতে লাগলেন। একটা পর্যায়ে খালেদ মোশাররফ বললেন, নতজানু হয়ে জীবন ভিক্ষা করে নিজেদের ছোট না করে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হওয়া ভালো।
খালেদ মোশাররফ সিগারেট ধরিয়ে তার স্ত্রী সালমাকে টেলিফোন করে এই মুহূর্তে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যেতে বললেন।
সালমা বললেন, তোমাকে একা ছেড়ে যাব?
মোশাররফ বললেন, হ্যাঁ। আমার তিন মেয়েকে টেলিফোন দাও, এদের গলার শব্দ শুনি। কে জানে হয়তো আর শুনব না।
সালমা আর্তধ্বনি বের করলেন, এইসব কী বলছ?
খালেদ মোশাররফ বললেন, আমার তিন রাজকন্যাকে দাও।
তিনি তাঁর কন্যাকে বললেন, তোমাদের মধুর হাসি, ভালোবাসি ভালোবাসি।
মেয়েদের সঙ্গে এটি তার পুরোনো খেলা। বাবার গলা শুনে তিন মেয়েই খিলখিল করে হাসছে। এরপর তিনি টেলিফোন করলেন সরফরাজ খানকে। তাঁদের মধ্যে কী কথা হলো জানা গেল না, তবে সরফরাজ খান তৎক্ষণাৎ গাড়ি নিয়ে বের হলেন। কোথায় গেলেন কেউ জানে না। তিনি আর ফিরে এলেন না। তার বেবি অস্টিন গাড়ি ক্যান্টনমেন্টের বাইরে পড়ে থাকতে দেখা গেল।
সাতই নভেম্বর খালেদ মোশাররফকে হত্যা করা হয়। বিপ্লবের নামে অফিসার হত্যার ব্যাপারটা সাধারণ সৈনিকেরা করত। খালেদ মোশাররফের ব্যাপারে এই দায়িত্ব দু’জন অফিসার পালন করেন। তাঁরা হলেন ক্যাপ্টেন আসাদ ও ক্যাপ্টেন জলিল। মজার ব্যাপার হলো, এই দু’জনকেই খালেদ মোশাররফ অত্যন্ত পছন্দ করতেন। কে ফোর্সের অধীনে এই দু’জন খালেদ মোশাররফের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এদের মধ্যে ক্যাপ্টেন আসাদকে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রুর হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন।
অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা বীরউত্তম খালেদ মোশাররফের মৃতদেহ ক্যান্টনমেন্টের রাস্তায় খেজুরগাছের নিচে অপমানে ও অবহেলায় পড়ে আছে। রাস্তার একটা কুকুর অবাক হয়ে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আছে।
কালাপাহাড়ও অবাক হয়ে শফিককে দেখছে। সে আনন্দ সামলাতে পারছে না। শফিক বসে আছে মোল্লার চায়ের দোকানের সামনের বাঁশের বেঞ্চে। কালাপাহাড় কিছুক্ষণ পরপর শফিককে চক্কর দিচ্ছে। প্রতিবারই চক্কর শেষ করে সে শফিককে দেখছে। শফিক বলল, কিরে আমাকে দেখে খুশি হয়েছিস?
কালাপাহাড় ঘোঁত জাতীয় শব্দ করল।
শফিক বলল, বিরাট ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলাম। উদ্ধারের আশা ছিল না। খালেদ মোশাররফ সাহেবের দয়ায় উদ্ধার পেয়েছি। শোন কালাপাহাড়, আমি যত দিন বেঁচে থাকব খালেদ সাহেবের গুণগান করব। তুইও করবি।
কালাপাহাড় আবারও ঘোঁত শব্দ করল।
শফিক বলল, এই ক’দিন খাওয়াদাওয়ার খুব কষ্ট হয়েছে। আর হবে না। মা’কে যখন দেখতে যাব, তোকেও নিয়ে যাব। ঠিক আছে?
কালাপাহাড় জবাব দিল না, শুধু মাথা নাড়ল। শফিক বলল, খালেদ মোশাররফ সাহেব আমার যে উপকার করেছেন তা আমি কোনোদিন ভুলব না। যেদিন ভুলব সেদিন থেকে আমি কুকুরের বাচ্চা।
কর্নেল তাহের তাঁর অনুগত সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে সিপাহী বিপ্লবের সূচনা করেন। সিপাহীরা গগনবিদারী স্লোগান দিতে শুরু করল—‘জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ’। কর্নেল তাহেরকে জড়িয়ে ধরে আবেগমথিত কণ্ঠে জিয়া বললেন, বন্ধু! তোমার এই উপকার আমি কোনোদিনই ভুলব না।
জেনারেল জিয়া কর্নেল তাহেরের উপকার মনে রেখেছিলেন কি না তা আমরা জানি না, তবে তিনি যে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছিলেন তা আমরা জানি।
দুঃখিনী বাংলাদেশের প্রদীপসম সন্তানেরা একে একে নিভে যেতে শুরু করল।
রাত একটা। অবন্তি ছাদে বসে আছে। খালেদ মোশাররফের মৃত্যুসংবাদ সে কিছুক্ষণ আগে পেয়েছে। অনেক ঝামেলা করে সে এই খবর পেয়েছে কর্নেল তাহেরের কাছ থেকে।