দেয়াল উপন্যাসের প্রথমদিকে হুমায়ুন আহমেদ নিজের উল্লেখ করেছে প্রথম পুরুষে, শেষদিকে এসে উত্তমপুরুষে নিজের কথা সে বলে গেছে। আমরা জানতে পারি—অনেকেরই তা অজানা নয় যে—শহীদ-পরিবার হিসেবে ঢাকা শহরে হুমায়ূনদের সরকারিভাবে যে-বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়, রক্ষী বাহিনীর এক কর্মকর্তা তা দখল করে তাদেরকে নির্মমভাবে সেখান থেকে উচ্ছেদ করে পথে নামিয়ে দেন; হুমায়ুনের মা এবং ভাইবোনেরা শুধু চরম অপমানের শিকার হন, তা নয়, নিরাপত্তার সম্পূর্ণ অভাবে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক হুমায়ূনকে বাকশালে যোগ দিতে চাপ দেওয়া হয় এবং চাপের কাছে নতিস্বীকার করে রসায়ন বিভাগে, রেজিস্ট্রারের অফিসে এবং উপাচার্যের দপ্তরে ছোটাছুটি করেও শেষ পর্যন্ত সময় উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে তার প্রয়াস নিষ্ফল হয়, বাকশালে যোগদান থেকে সে বেঁচেই যায় বলতে হবে। এসব ঘটনা বঙ্গবন্ধুর সরকার সম্পর্কে তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। অন্যপক্ষে কর্নেল তাহেরের ভাই আনোয়ার হোসেনের সূত্রে তাহেরের সঙ্গে সে পরিচিত হয়, তার মাকে নিজের মায়ের মতো দেখতে অভ্যস্ত হয়। তাহেরের জীবনাবসান তার মনে গভীর দাগ ফেলে যায়—এতটাই যে ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনকে অপহরণের পরিকল্পনাকে সাহসী’ বলে উপন্যাসে প্রশংসা করা হয়েছে। আমার ধারণা, হুমায়ূনের এই ব্যক্তিগত পটভূমি এই উপন্যাসের চরিত্র ও ঘটনার উপস্থাপনে তাকে প্রভাবান্বিত করেছে।
প্রথম আখ্যানেই আমরা পরিচিত হুমায়ূন আহমেদকে পাই। চরিত্রের খেয়ালিপনা, সংলাপের সংঘাত, ঘটনার আকস্মিকতা ও কার্যকারণহীনতা আমাদের সবসময়ে রহস্যময়তার দিকে আকর্ষণ করে। দ্বিতীয় আখ্যানের ঐতিহাসিকতা প্রমাণের জন্যে হুমায়ূন বইপত্র এবং মামলার কাগজপত্রের শরণাপন্ন হয়েছে। তবে তারপরও তথ্যগত ত্রুটি রয়ে গেছে। কাহিনি বলা থামিয়ে লেখক কখনো তারিখ দিয়ে মোটা দাগে ঘটনার বিবরণ লিখে গেছে। শেষে এক লাফে ছ বছর সময় পেরিয়ে উপসংহারে পৌঁছেছে।
এরই মধ্যে ছড়িয়ে আছে হুমায়ুনের স্বভাবসিদ্ধ এপিগ্রাম। সামান্য নমুনা দিই :
মানুষ এবং পশু শুধু যে বন্ধু খোঁজে তা না, তারা প্রভুও খোঁজে।
এই পৃথিবীতে মূল্যবান শুধু মানুষের জীবন, আর সবই মূল্যহীন।
কিছু বিদ্যা মানুষের ভেতর থাকে। সে নিজেও তা জানে না।
যে লাঠি দিয়ে অন্ধ মানুষ পথ চলে, সেই লাঠি দিয়ে মানুষও খুন করা যায়।
মানবজাতির স্বভাব হচ্ছে সে সত্যের চেয়ে মিথ্যার আশ্রয়ে নিজেকে নিরাপদ মনে করে।
সমালোচক যা-ই বলুক না কেন, আমি জানি, হুমায়ূন আহমেদের অন্য বইয়ের মতো দেয়ালও পাঠকের সমাদর লাভ করবে।
আনিসুজ্জামান
বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
ভাদ্র মাসের সন্ধ্যা
ভাদ্র মাসের সন্ধ্যা। আকাশে মেঘ আছে। লালচে রঙের মেঘ। যে মেঘে বৃষ্টি হয় না, তবে দেখায় অপূর্ব। এই গাঢ় লাল, এই হালকা হলুদ, আবার চোখের নিমিষে লালের সঙ্গে খয়েরি মিশে সম্পূর্ণ অন্য রঙ। রঙের খেলা যিনি খেলছেন মনে হয় তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।
শফিক চা খেতে খেতে আকাশের রঙের খেলা দেখছে। সে চা খাচ্ছে ধানমণ্ডি দশ নম্বর রোডের মাঝখানে একটা চায়ের দোকানে। অস্থায়ী দোকান ছিল, এখন মনে হয় স্থায়ী হয়ে গেছে। হালকা-পাতলা শিরিষ গাছের পাশে দোকান। শিরিষ গাছের মধ্যে তেজিভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। সে আকাশ স্পর্শ করার স্পর্ধা নিয়ে বড় হচ্ছে।
শফিক চা শেষ করে পকেটে হাত দিয়ে দেখে মানিব্যাগ আনে নি। এরকম ভুল তার সচরাচর হয় না। তার আরেক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করছে। চায়ের সঙ্গে সিগারেট। শফিক মনস্থির করতে পারছে না। সঙ্গে মানিব্যাগ নেই—এই তথ্য দোকানিকে আগে দেবে, নাকি চা-সিগারেট খেয়ে তারপর দেবে!
শফিকের হাতে বিভূতিভূষণের একটা উপন্যাস। উপন্যাসের নাম ইছামতি। বইটির দ্বিতীয় পাতায় শফিক লিখেছে—‘অবন্তিকে শুভ জন্মদিন’। বইটা নিয়ে শফিক ব্রিত অবস্থায় আছে। বইটা অবন্তিকে সে দিবে, নাকি ফেরত নিয়ে যাবে? এখন কেন জানি মনে হচ্ছে ফেরত নেওয়াই ভালো।
অবন্তির বয়স ষোল। সে ভিকারুননিসা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। শফিক তাকে বাসায় অংক শেখায়। আজ অবন্তির জন্মদিন। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শফিককে বলা হয় নি। অবন্তি শুধু বলেছে, তের তারিখ আপনি আসবেন না। ওইদিন আমাদের বাসায় ঘরোয়া একটা উৎসব আছে। আমার জন্মদিন।
শফিক বলেছে, ও আচ্ছা!
অবন্তি বলেছে, জন্মদিনে আমি আমার কোনো বন্ধুবান্ধবকে ডাকি না। দাদাজান তার বন্ধুবান্ধবকে যেতে বলেন।
শফিক আবারও বলেছে, ও আচ্ছা।
অবন্তি বলেছে, আপনাকে জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করা হয় নি, এই নিয়ে মন খারাপ করবেন না।
শফিক তৃতীয়বারের মতো বলল, ও আচ্ছা। শেষবারে ‘ও আচ্ছা’ না বলে বলা উচিত ছিল ‘মন খারাপ করব না’।
যে উৎসবে শফিকের নিমন্ত্রণ হয় নি, সেই উৎসব উপলক্ষে উপহার কিনে নিয়ে যাওয়া অস্বস্তির ব্যাপার। শফিক ঠিক করে রেখেছে বইটা অবন্তিদের বাড়ির দারোয়ানের হাতে দিয়ে আসবে। সমস্যা একটাই—দারোয়ান সবদিন থাকে না। গেট থাকে ফাঁকা। তবে আজ যেহেতু বাড়িতে একটা উৎসব, দারোয়ানের থাকার কথা।
শফিক দোকানির দিকে তাকিয়ে বলল, মানিব্যাগ আনতে ভুলে গেছি। আপনার টাকাটা আগামীকাল ঠিক এই সময় দিয়ে দিব। চলবে?