পীরবাড়িতে আমার জীবনযাত্রাটা বলি। সূর্য ওঠার আগে সালমা আমাকে ডেকে তোলে। আমাকে ঘাটে নিয়ে যায় গোসল করার জন্যে। ঠান্ডায় গোসলের এই কাজ খুব কষ্টকর। পুকুরভর্তি বালি মাছ। গোসলের সময় এই মাছ সারাক্ষণ গায়ে ঠোকর দেয়। বিশ্রী লাগে।
ফজরের আজানের পরপর নামাজের জন্যে দাঁড়াতে হয়। ইমামতি করেন পীর সাহেব। মেয়েদের ও বারো বছরের নিচের বালকদের আলাদা নামাজের ব্যবস্থা। পুরুষদের নামাজ ও মেয়েদের নামাজ একসঙ্গেই হয়, তবে মাঝখানে দেয়াল আছে। নামাজের সময় মেয়েরা ইমামকে দেখতে পারে না, তবে তার কথা শুনতে পারে।
ফজরের নামাজের পরপর মেয়েরা যে যার ঘরে চলে যায়। এই সময় বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে কোরান পাঠ করতে হয়। সকালে নাশতার ডাক এলে কোরানপাঠ বন্ধ হয়। নাশতা হিসেবে থাকে রাতের বাসি পোলাও ও বাসি মাংস।
জোহরের নামাজের পর দুপুরের খাওয়ার ডাক আসে। দুপুরে গণখাবার রান্না হয়। প্রতিবারই দেড় শ’ থেকে দু’ শ’ মানুষ খায়। বাড়ির মেয়েরা এই খাবার খেতে পারে কিংবা নিজেদের জন্যে মাছ, ডাল, সবজিও খেতে পারে।
এশার নামাজের পর রাতের খাবার। রাতের খাবার পীরবাড়ির বাইরের কেউ খেতে পারে না। জ্বিনেরা রাতের খাবারে অংশগ্রহণ করে বলে (?) রাতে সবসময় পোলাও ও মাংস থাকে। গরুর মাংস না, খাসি কিংবা মুরগি।
জ্বিনেরা নাকি গো-মাংস পছন্দ করে না।
আমি সালমাকে বললাম, জ্বিনেরা রাতে খেতে আসে?
সালমা বলল, সবদিন আসে না, মাঝে মধ্যে আসে। পীর বাবার জ্বিন সাধনা। এই কারণেই আসে। মাসে একবার জ্বিন মিলাদ পড়ায়।
আপনি জ্বিন দেখেছেন?
আমি জ্বিন দেখি নাই, তয় একবার তারার মিলাদে ছিলাম। জ্বিনের ক্যানক্যানা মেয়েছেলের মতো গলা। মিলাদের শেষে জ্বিনমুলুকের তবারক ছিল। সবুজ কিসমিস।
খেতে কেমন?
মিষ্টি, তয় সামান্য ঝালভাবও আছে। আপনে যখন আছেন, তখন জ্বিনের মিলাদ নিজের চউখে দেখবেন। জ্বিনমুলুকের ফলফ্রুট ইনশাল্লাহ খাবেন।
পীর বাবার সঙ্গে এক সন্ধ্যাবেলায় মিলিটারি ক্যাপ্টেন দেখা করতে এলেন। তাঁর নাম সামস আরমান। সবাই ডাকত ক্যাপ্টেন সামস। জ্বিনের মিলাদ দেখার জন্যে আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করলেন। পীর বাবা ক্যাপ্টেন সাহেবের আগ্রহ দেখে বিশেষ ব্যবস্থায় জ্বিনের মিলাদের আয়োজন করলেন। ক্যাপ্টেন সাহেবের আগমন উপলক্ষে বিশেষ খাবারের আয়োজন হলো। দুটি খাসি জবেহ করা হলো। খাসির রেজালা, মুরগির রোস্ট এবং পোলাও।
ক্যাপ্টেন সাহেবের উপস্থিতির কারণে জ্বিনের মিলাদে বাড়ির মেয়েরা উপস্থিত থাকতে পারল না। ক্যাপ্টেন সাহেব জ্বিনের মিলাদ দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। এরপর থেকে তিনি প্রায়ই পীর বাবার হুজরাখানায় আসতে শুরু করলেন। ক্যাপ্টেন সাহেবের আগ্রহে পীর বাবা খাতিমনগরে শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান হয়ে গেলেন। হুজরাখানার সবাই খুশি। পাকিস্তানের সেবা করার সুযোগ পাওয়া গেল। এই প্রথম হুজরাখানার মূল গেটে পাকিস্তানের পতাকা উড়তে লাগল। পতাকাটা অদ্ভুত। পতাকার মাথায় কায়দে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নার বাধাই করা ছবি। তার নিচে পতাকা।
সারা দেশে তখন ভয়ঙ্কর অবস্থা চলছে। দেশের মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্যে পালিয়ে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে। মিলিটারিরা নির্বিচারে মানুষ মারছে, মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা আছি পরম সুখে। পীর বাবার হুজরাখানা সমস্ত ঝামেলা থেকে মুক্ত। এখানে প্রতি জুম্মাবারে পাকিস্তানের জন্যে দোয়া হয়, মিলাদ হয়। একবার খবর পাওয়া গেল, জ্বিনেরা বাগাদে বড় পীর সাহেবের মাজারে মিলাদ করেছে। তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশ কখনো স্বাধীন হবে না। দুষ্কৃতিকারীরা সবাই মারা পড়বে। জ্বিনেরা নাকি মানুষের চেয়ে কিছু কিছু বিষয়ে উন্নত। তারা ভবিষ্যৎ দেখতে পারে।
জুন মাসের আট তারিখ দুপুরে পীর বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। হুজরাখানায় তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। তাঁর এক হাতে তসবি, অন্য হাতে হুক্কার নল।
পীর বাবা বললেন, তোমার সঙ্গে কি কখনো পাকিস্তান মিলিটারির ক্যাপ্টেন সামসের দেখা হয়েছে?
আমি বললাম, না।
পীর বাবা বিরক্ত গলায় বললেন, ভাবনাচিন্তা করে জবাব দাও। তিনি অবশ্যই তোমাকে দেখেছেন। তুমি আমবাগানে আম কুড়াতে গিয়েছিলে। তোমার সঙ্গে আরেকজন ছিল।
জি। সালমা ছিল। আমরা পেছনের গেট দিয়ে বাগানে গিয়েছিলাম।
বোরকা ছিল না?
জি-না।
ক্যাপ্টেন সামস তোমাকে দেখেছেন এবং আমার কাছে বিবাহের পয়গাম পাঠিয়েছেন। তুমি দেশের অবস্থা জানো না। দেশের যে অবস্থা তাতে পাকিস্তানি মিলিটারির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা অসম্ভব।
আমি চুপ করে বসে আছি। পীর বাবাও চুপ করে আছেন। তামাক টেনে যাচ্ছেন।
একসময় তিনি নীরবতা ভঙ্গ করে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি ক্যাপ্টেন সাহেবকে বলেছি, এই মেয়েটির আমার ছেলে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিবাহ হয়েছে। মিথ্যা কথা বলেছি। মহাবিপদে জীবন রক্ষার জন্যে মিথ্যা বলা জায়েজ আছে। তোমাকে যে কোথাও পাঠাব সেই উপায় নাই। তোমার পিতা কোথায় আছেন তাও জানি না। এমন অবস্থায় জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তোমার বিবাহ দেওয়া ছাড়া আমার উপায় নাই। আগামী শুক্রবারে বাদ জুম্মা তোমার বিবাহ। এখন সামনে থেকে যাও। একটা কথা মনে রাখবা, যা ঘটে আল্লাহপাকের হুকুমেই ঘটে। তার হুকুমের বাইরে যাওয়ার আমাদের কোনো উপায় নাই। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তোমার বিবাহ আল্লাহর হুকুমেই হবে। আমার হুকুমে না।