খ্রিষ্টান। ক্যাথলিক খ্রিষ্টান।
পীর সাহেব বললেন, মুসলমান ছেলে খ্রিষ্টান বিবাহ করতে পারে। নবিজি মরিয়ম নামের এক খ্রিষ্টান কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। তার গর্ভে এক পুত্রসন্তানও হয়েছিল। সন্তানের নাম ইব্রাহিম। এখন আমার প্রশ্ন, তোমার পুত্রের সঙ্গে খ্রিষ্টান মেয়ের বিবাহ কি ইসলাম ধর্মমতে হয়েছে?
জি হুজুর।
আলহামদুলিল্লাহ। এটা একটা সুসংবাদ। তুমি তোমার নাতনিকে আমার এখানে রাখতে চাও?
জি জনাব।
মেয়ের বাবা কোথায়?
মেয়ের বাবা কোথায় আমি জানি না। আমার ছেলে তিন বছর বয়সের মেয়েকে এনে আমার কাছে রেখে স্পেনে চলে যায়। এরপর আর তার খোঁজ জানি না।
সে কি জীবিত আছে?
তাও জানি না।
পীর সাহেব বললেন, জ্বিনের মাধ্যমে তোমার পুত্রের সংবাদ আমি এনে দিতে পারি। সেটা পরে দেখা যাবে। এই মেয়ের নাম কী?
অবন্তি।
এটা কেমন নাম?
তার বাবা রেখেছে।
সন্তানের সুন্দর ইসলামি নাম রাখা মুসলমানের কর্তব্য। আমি এই মেয়ের নাম রাখলাম, মায়মুনা! মায়মুনা নামের অর্থ ভাগ্যবতী।
দাদাজান চুপ করে রইলেন।
পীর সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি কোরানমজিদ পাঠ করতে পারো?
আমি বললাম, পারি। কে শিখিয়েছে? তোমার খ্রিষ্টান মা?
না। আমার দাদাজান আমার জন্যে একজন হুজুর রেখে দিয়েছিলেন। হুজুরের নাম বলব?
পীর সাহেব বললেন, নাম বলতে হবে না। তুমি কথা বেশি বলো। কথা কম বলবে। তোমার অজু আছে?
জি-না।
যাও, অজু করে এসে আমাকে কোরানমজিদ পাঠ করে শোনাও। সূরা ইয়াসিন পাঠ করবে।
আমি সূরা ইয়াসিন পড়লাম। পীর সাহেব বললেন, পাঠ ঠিক আছে। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। সরফরাজ, তোমার নাতনি মায়মুনাকে আমি জুলেখার হাতে হাওলা করে দিব। সে নিরাপদে থাকবে। তবে তাকে কঠিন পর্দার ভেতর থাকতে হবে। আমার এখানে তা-ই নিয়ম।
দাদাজান বললেন, আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই সে থাকবে।
পীর সাহেবের কাছে থাকার সময়ই খবর পেলাম, দাদাজানের বাড়িতে মিলিটারি এসে উঠেছে। মিলিটারি ক্যাপ্টেন ঘাঁটি হিসেবে বাড়ি পছন্দ করেছেন। তাদের নিরাপত্তার জন্যে বাড়ির চারদিকের সব গাছপালা কাটার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ধীরেন কাকা ও তার স্ত্রীকে যে মিলিটারিরা গুলি করে মেরে ফেলেছেএই খবর তখনো আসে নি।
দাদাজান আমাকে রেখে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। আমার হাতে এক শ’ টাকার নোটে দুই হাজার টাকা দিলেন এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, আমার ব্যক্তিগত পিস্তলটা তোকে দিয়ে যাচ্ছি। ভালো করে দেখে নে। বারো রাউন্ড গুলি ভরা আছে। সেফটি ক্যাচ লাগানো অবস্থায় ট্রিগার চাপলে গুলি হবে না। সেফটি ক্যাচ কীভাবে খুলতে হয় দেখ। এইভাবে।
আমি বললাম, সেফটি ক্যাচ খেলার কায়দা জেনে আমি কী করব? কাকে আমি গুলি করে মারব?
দাদাজান বললেন, কাউকে মারবি না। জিনিসটা জানা থাকল।
আমি বললাম, তুমি কোথায় যাবে?
দাদাজান বললেন, জানি না কোথায় যাব। ঢাকায় যেতে পারি।
মিলিটারিরা তোমার বাড়ি দখল করে বসে আছে। তাদের কিছু বলবে না?
না।
পীর সাহেবের এই বাড়িতে আমি কত দিন থাকব?
মলিটারির গুষ্টি বিদায় না হওয়া পর্যন্ত থাকবি। আমি মাঝে মধ্যে এসে খোঁজ নিব। পিস্তলটা লুকিয়ে রাখবি। পিস্তলের বিষয়টা কেউ যেন না জানে।
কেউ জানবে না।
পীর সাহেবের বাড়িতে আমার জীবন শুরু হলো। খুব যে কষ্টকর জীবন তা না। দোতলার সর্বউত্তরের একটা ছোট্ট ঘর আমাকে দেওয়া হলো। ঘরে একটাই জানালা। এই জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যায় না। জানালার সামনেই বটগাছের সাইজের এক কড়ইগাছ। ঘরে আমি একা থাকি। শুধু রাত্রে সালমা নামের মধ্যবয়স্ক এক দাসী মেঝেতে পাটি পেতে ঘুমায়। তার চেহারা কদাকার। মুখে বসন্তের দাগ, একটা চোখ নষ্ট। মানুষ হিসেবে সে অসাধারণ, মানসিক সৌন্দর্যের কাছে তার শারীরিক ত্রুটি সম্পূর্ণ ঢাকা পড়েছিল। প্রথম রাতেই সে আমাকে বলল, আম্মাজি, আপনি ভয় খাইয়েন না। আমি আছি।
আমি বললাম, ভয় পাব কী জন্যে?
সালমা বলল, আপনের বয়স অল্প। আপনে হুরের মতো সুন্দর। কিংবা কে বলবে, হুরের চেয়েও সুন্দর। আমি তো আর হুর দেখি নাই। আপনের মতো মেয়েছেলের কাইকে কাঁইকে (কদমে কদমে) বিপদ। আপনে সাবধানে চলবেন। আমার একটাই নয়ন। এই নয়ন আপনের উপর রাখলাম।
আমি বললাম, একটা নয়ন আমার উপর রেখে দিলে কাজকর্ম করবেন কীভাবে? তারচেয়েও বড় কথা, নয়ন আপনি আমার উপর রাখছেন কী জন্যে?
সালমা বলল, ছোট মা’র হুকুম।
ছোট মা হলো পীর সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী। তাঁর নাম জুলেখা বিবি। তাঁর একটিই সন্তান, জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীর কোরানে হাফেজ। জুলেখা বিবি আরামে ও আলস্যে সময় কাটান। বেশির ভাগ সময় চুল এলিয়ে উবু হয়ে বসে থাকেন। তখন তাঁর গায়ের কাপড় ঠিক থাকে না। এই নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথাও দেখা যায় না। মনে হয় তিনি তাঁর সুন্দর শরীর দেখাতে পছন্দ করেন। তাঁর মতো রূপবতী মেয়ে আমি কম দেখেছি। প্রায় নগ্ন এই মহিলাকে একজন দাসী তার চুলে বিলি করে দেয়। চুলের উকুন বাছে। সপ্তাহে দুদিন বাটা মেন্দি মাথায় দিয়ে দেয়। আরেকজন দাসী তার পায়ের পাতায় তেল ঘষে। এই দাসীরাই তাঁর কাজা নামাজ আদায় করে। রোজার সময় তার হয়ে রোজা রাখে। তিনি নামাজ-রোজা কিছুই করেন না।
এই অদ্ভুত মহিলার ওপর প্রতি অমাবস্যা রাতে কিসের যেন আছর হয়। তখন তিনি জন্তুর মতো গোঁ গোঁ শব্দ করতে থাকেন। তার মুখ দিয়ে লালা পড়ে। তিনি পুরুষের গলায় বলেন, শইল গরম হইছে। শইল্যে পানি দে। বরফপানি দে। তখন তার গায়ে বালতি বালতি বরফপানি ঢালা হয়। অমাবস্যা উপলক্ষ করেই বরফকল থেকে চাক চাক বরফ কেনা হয়। আছরগ্রস্ত অবস্থায় তাঁর তিন দাসী ছাড়া অন্য কেউ সামনে যায় না।