ধীরেন কাকা আমাকে রান্না শেখাতেন। অধ্যাপকের ভঙ্গিতে বক্তৃতা দিয়ে রান্না শেখানো। এই সময় রাধা কাকি তার পাশে থাকতেন। রান্নার বক্তৃতা শুনে মিটিমিটি হাসতেন। ধীরেন কাকার রান্না-বিষয়ক বক্তৃতামালা।
মা! সবচেয়ে কঠিন রান্না হলো মাছ রান্না। মাছের আছে আঁশটে গন্ধ। রান্নার পর যদি মাছের আঁশটে গন্ধ থাকে, তখন সেই মাছ হয় ভূত-পেত্নির খাবার। প্রথমেই আঁশটে গন্ধ দূর করবে।
এ কাজ কীভাবে করা হবে?
প্রথমে লবণ মেখে কচলাবে। তারপর পানি দিয়ে ধুয়ে লবণ ফেলে দেবে। এরপর দেবে লেবুর রস। কাগজিলেবু হলে ভালো হয়। এই লেবুর গন্ধ কড়া। লেবুর রস দিয়ে মাখানোর পর আবার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলে দেবে। সব মিলিয়ে তিন ধোয়া। এর বেশি না। মাংসের ক্ষেত্রে ভিন্ন ব্যবস্থা। মাত্র এক ধোয়া।
রান্নাবিষয়ে ধীরেন কাকার সব কথা আমি একটা রুলটানা খাতায় খুব গুছিয়ে লিখেছিলাম। খাতাটা হারিয়ে গেছে। খাতাটা থাকলে রান্নার একটা বই লেখা যেত। তবে কৈ মাছ রান্নার একটা রেসিপি আমার মনে আছে। রেসিপিটা এ রকম—
একটা কৈ মাছ সরিষা বাটা, লবণ এবং একটা ঝাল কাঁচামরিচ দিয়ে মাখিয়ে কলাপাতায় মুড়ে ভাতের মাড় ফেলা অবস্থায় হাঁড়িতে ঢুকিয়ে দেওয়া। ব্যস হয়ে গেল।
রাধা কাকি ছিলেন ভূতের গল্পের ওস্তাদ। তাঁর কাছ থেকে কত যে গল্প শুনেছি! বেশির ভাগ গল্পই বাস্তব অভিজ্ঞতার। তিনি নিজে দেখেছেন এমন। তাঁর কথায় সব ভূত ভীতুপ্রকৃতির। মানুষের ভয়ে তারা অস্থির থাকে। শুধু একশ্রেণীর পিশাচ আছে, যারা মানুষকে মোটেই ভয় পায় না। এরা হিংস্র জন্তুর মতো।
আমি বললাম, কাকি, আপনি এই ধরনের পিশাচ দেখেছেন?
কাকি বললেন, একবার দেখেছি। ঘটনা বলি শোনো, আমি এই বাড়ির বারান্দায় বসা। সন্ধ্যা মিলিয়েছে, আমি বড়ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে বারান্দায় এসেছি, তখন দেখলাম পানির নিচ থেকে পিশাচটা উঠল। থপ থপ শব্দ করে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এসে উঠানে দাঁড়াল। মুখ দিয়ে ঘোড়ার মত শব্দ করল।
দেখতে কেমন?
মানুষের মতো। মিশমিশা কালো। হাতের আঙুল অনেক লম্বা। আঙুলে পাখির নখের মতো নখ। পিশাচটা দেখে ভয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি—এই সময় একটা কুকুর ছুটে এল। কুকুর দেখে পিশাচটা ভয় পেয়ে দৌড়ে পানিতে নেমে ডুব দিল। পিশাচরা কিছুই ভয় পায় না, শুধু কুকুর ভয় পায়। কুকুর তাদের কাছে সাক্ষাৎ যম।
দাদাজানের সঙ্গে আমার তেমন কথা হতো না। তিনি সারাক্ষণ ট্রানজিস্টারে খবর শুনতেন। মাঝে মাঝে তিন মাইল দূরে হামিদ কুতুবি নামের এক পীর সাহেবের আস্তানায় যেতেন। তিনি এই পীরের মুরিদ হয়েছিলেন। যখন ট্রানজিস্টার শুনতেন না, তখন পীর সাহেবের দেওয়া দোয়া জপ করতেন। দাদাজান আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। প্রতিদিনই তাঁর আতঙ্ক বাড়ছিল। রাতে তিনি ঘুমুতে পারতেন না। সারা রাত বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে থাকতেন। ভবিষ্যৎ জানার জন্যে তিনি এক রাতে ইস্তেখারা করলেন। ইস্তেখারায় দেখলেন, একটা প্রকাণ্ড ধবধবে সাদা পাখি যার চোখ টকটকে লাল, সে আকাশ থেকে নেমে আমার চুল কামড়ে ধরে আকাশে উঠে গেছে। আমি চিৎকার করছি, বাঁচাও! বাঁচাও! দাদাজান আমাকে বাঁচাও। দাদাজান আমাকে বাঁচানোর জন্যে হেলিকপ্টারে করে উঠে গেলেন। সেই হেলিকপ্টার আবার চালাচ্ছে একজন পাকিস্তানি পাইলট। হেলিকপ্টার চালাবার ফাকে ফাকে সে পিস্তল দিয়ে পাখিটাকে গুলি করছে। কোনো গুলি পাখির গায়ে লাগছে না। লাগছে অবন্তির গালে।
দাদাজানের পীর হামিদ কুতুবি স্বপ্নের তাবীর করলেন। কী তাবীর তা দাদাজান আমাকে বললেন না, তবে তিনি আরও অস্থির হয়ে পড়লেন। চারদিক থেকে তখন ভয়ংকর সব খবর আসতে শুরু করেছে। মিলিটারিরা গানবোট নিয়ে আসছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, নির্বিচারে মানুষ মারছে, অল্পবয়সী মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এইসব।
একসময় আমাদের অঞ্চলে মিলিটারি চলে এল। খাতিমনগরে মিলিটারির গানবোট ভিড়ল। দাদাজানের বাড়ি থেকে খাতিমনগর বাজার দু’মাইল দূরে। খবর শোনামাত্র দাদাজান আমাকে নিয়ে তাঁর পীর সাহেবের হুজরাখানায় উপস্থিত হলেন।
বিশাল এলাকাজুড়ে পীর সাহেবের হুজরাখানা। চারদিকে দেয়াল, দেয়ালের ওপর কাটাতার। দুর্গের মতো ব্যাপার। হুজরাখানার ভেতরে দুটি মাদ্রাসা আছে। একটি ছেলেদের, একটি মেয়েদের। দুটিই হাফেজি মাদ্রাসা। কোরানশরিফ মুখস্থ করানো হয়। হুজরাখানার পেছনে পীর সাহেবের দোতলা বাড়ি। একতলায় থাকেন পীর সাহেবের প্রথম স্ত্রী। তার কোনো সন্তানাদি নেই। দোতলায় থাকেন পীর সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী। তাঁর নাম জুলেখা। এই স্ত্রীর গর্ভে একটি সন্তান আছে। তাঁর নাম জাহাঙ্গীর। তিনি কোরানে হাফেজ। রূপবান এক যুবক। স্র এবং ভদ্র। মেয়েদের মতো চোখে গাঢ় করে কাজল দেন। তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকবার আমার দেখা হয়েছে। তিনি কখনো মাথা তুলে তাকান নি। হুজরাখানার পুরুষদের মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর নিয়ম নেই।
আমি পীর সাহেবের সামনে বসে আছি। আমার পাশে দাদাজান। পীর সাহেব নামাজের ভঙ্গিতে বসেছেন। তার বয়স অনেক, তবে তিনি শারীরিকভাবে মোটেই অশক্ত না। পীর সাহেবের ডানহাতে তসবি। তসবির দানাগুলি নীল রঙের, অনেক বড় বড়। তিনি একমনে তসবি টেনে যাচ্ছেন। ঘরে আরও কয়েকজন ছিল, তাদের হাতেও তসবি। পীর সাহেবের নির্দেশে তারা বেরিয়ে গেল। একজন এসে ফরসি হুক্কা দিয়ে গেল। পীর সাহেব হুক্কায় টান দিতে দিতে বললেন, সরফরাজ! তোমার এই নাতনির মা বিদেশিনী, সেটা জানলাম। তার ধর্ম কী?